বড়দিনে মুসলিম শিশুদের কাছে ক্রিসমাস এবং যীশুর বিষয় কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন


এ্যাবাউট ইসলাম
Published: 2023-12-16 03:30:50 BdST | Updated: 2024-05-14 06:46:02 BdST

প্রতি বছর ক্রিসমাসের সময় পাশ্চাত্যে বসবাসকারী অনেক মুসলিম পরিবার এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। আমরা ভাবি যে এই ছুটির দিনসমূহে বড়দিন এবং যীশু সম্পর্কে আমাদের বাচ্চাদের কী বলব?

এই বছর আপনি কি বলবেন যখন আপনার বাচ্চারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, "কেন মুসলিমরা বড়দিন উদযাপন করে না?"

আপনার সন্তানরা একটি মিশ্র সংস্কৃতির সমাজে মিশ্র ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হচ্ছে। এমতাবস্থায় আপনি তাদেরকে বড়দিনের ছুটি সম্পর্কে কী বলবেন?

প্রতিবেশীদের সম্মান করতে শেখান
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথম মুসলিমদেরকে একত্রিত করার পর বা মদীনায় আসার পর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন। মুসলিমরা তখন খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘু ছিল। যেভাবে হাদীসে বর্ণিত আছে, নাজরানের অধিবাসীরা তাঁর পক্ষ থেকে  সুরক্ষা পেয়েছে এবং সেখানের খ্রিস্টানদের জীবন, বিশ্বাস, ভূমি, সম্পত্তি, যারা অনুপস্থিত এবং যারা উপস্থিত রয়েছে এবং তাদের গোষ্ঠী এবং মিত্রদের রক্ষা করার জন্য রাসূল (সা.) এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যাতে তাদের অতীত প্রথার কিছু পরিবর্তন করতে হবে না। তাদের বা তাদের ধর্মের কোন পরিবর্তন করা হবে না। কোনো গির্জার নেতা, সন্ন্যাসী বা গির্জার গার্ডকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হবে না।” (সালাহি, আদিল: হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে নাজরান খ্রিস্টানদের সাক্ষাৎ)

সম্মান গুরুত্বপূর্ণ
এটা গুরুত্বপূর্ণ যে মুসলিম পিতামাতারা তাদের সন্তানদের অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করতে শেখান। এটা উল্লেখ করা অপরিহার্য যে, মুসলিমরা তা ই ঘৃণা করে আল্লাহ যা অনুমতি দেননি। কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের লোকদের ঘৃণা করে না। অন্যান্য ধর্মের লোকেদের শেখার ও বেড়ে ওঠার আলাদা জায়গা সবসময় থাকে। আমরা তা অনুসরন করিনা। তাদের নিজস্ব রীতিনীতি রয়েছে, আর আমাদেরও নিজস্ব রীতিনীতি আছে।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, "তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের দ্বীন" (কোরআন ১০৯:৬)

আপনার সন্তানদের অন্য লোকেদের বিশ্বাসকে উপহাস করা থেকে দূরে থাকতে শেখান।

মহান আল্লাহ বলেন, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা করে তাদেরকে গালি দিও না, পাছে তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে। এইভাবে, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে তার নিজস্ব কাজকে সুশোভিত করেছি; অতঃপর তাদের প্রভুর কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন, অতঃপর তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন যা তারা করত। (কোরআন, ৬:১০৮)।

আপনার বাচ্চাদের ঈসা (আ.) এর গল্প বলুন
আপনার সন্তানকে জানান যে ক্রিসমাস শব্দটি এসেছে খ্রিস্ট শব্দ থেকে যা যীশু খ্রীষ্ট বা ঈসা (আ.) কে ডাকতে ব্যবহৃত হয়। "মশ" মানে হচ্ছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিস্ট মানে "মশীহ" বা আল্লাহর "বার্তাবাহক"। এটি একটি সম্মানজনক উপাধি। যীশু আরবীতে ঈসা (আ.) নামে পরিচিত, যেমনটি কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি মুসলিমদের পরম শ্রদ্ধা রয়েছে। যতবারই মুসলিমরা যীশু বা ঈসা (আ.) এর নাম উল্লেখ করে, তখনই তারা "সালাম" বা আলাইহিস সালাম বলে। কোরআনে হযরত ঈসা (আ.) এর নাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নামের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। আপনার সন্তানকে বোঝান যে হযরত ঈসা মসিহ ইসলাম ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, আমরা বিশ্বাস করি যে তাঁর বিষয়ে বর্ণিত ঘটনা সম্পর্কে তাদের সাথে আমাদের বড় পার্থক্য রয়েছে।

ঈসা মসিহ এবং তাঁর মা মরিয়ম সম্পর্কিত কোরআনের সূরা সমূহ পড়ুন। আলে ইমরান বা "ইমরানের পরিবার" নামে কোরআনের তৃতীয় সূরা এবং "মারিয়াম" নামক কুরআনের উনিশতম সূরা দেখুন। কোরআন, বাইবেলের মতো, নিশ্চিত করে যে যীশু বা ঈসা (আ.) একজন মা থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু পিতা থেকে নয়। যেটা নিশ্চিত করে যে তাঁর জন্ম অলৌকিক ছিল।

পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলেছিল, হে মরিয়ম, আল্লাহ তোমাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি বাণীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হচ্ছে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা। তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্য প্রাপ্তদের একজন। আর তিনি দোলনা হতে ও পরিণত বয়সে লোকের সাথে কথা বলবে এবং সে পুণ্যবানগণের অন্তর্ভুক্ত হবে। মারইয়াম বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! কীভাবে আমার পুত্র হবে, অথচ আমাকে কোন মানব স্পর্শ করেনি’। তিনি বললেন, ‘এভাবেই’ আল্লাহ সৃজন করেন যা তিনি ইচ্ছে করেন, তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘‘হয়ে যাও’’ সুতরাং তা হয়ে যায়। " (কোরআন, ৩:৪৫-৪৭)

পারিবারিক পার্থক্য
মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে যীশু (আ.) প্রতিবেশীদের অভিযোগের বিরুদ্ধে তার মাকে রক্ষা করার জন্য এবং আল্লাহর বার্তা প্রচার করার জন্য শিশুকালে কথা বলতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যদিকে, খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যীশু ত্রিশ বছর বয়সে প্রচার শুরু করেছিলেন।

পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, অতঃপর মারইয়াম ইঙ্গিতে সন্তানকে দেখাল; তারা বলল, যে কোলের শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব? শিশুটি (ঈসা) বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর বান্দাহ, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আর আমাকে নবী করেছেন।" (কোরআন, ১৯:২৯-৩০)।

তাঁর অলৌকিক জন্মের কারণে খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যীশু ঈশ্বরের পুত্র। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে তিনি শুধুমাত্র আল্লাহর একজন রাসূল। যেভাবে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে- এই হচ্ছে মারইয়াম পুত্র ঈসা। এটাই সঠিক বক্তব্য, যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করে বিতর্ক করছে। সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর কাজ নয়, তিনি পবিত্র, মহান; যখন তিনি কিছু করার সিদ্ধান্ত করেন তখন তার জন্য শুধু বলেন, ‘হয়ে যাও’, আর তা হয়ে যায়। (কোরআন ১৯:৩৪-৩৫)।

যীশুর অলৌকিক ঘটনা
খ্রিস্টান এবং মুসলিম উভয়ই বিশ্বাস করে যে ঈসা (আ.) তাঁর জীবনে অনেক অলৌকিক কাজ করেছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছে যে তিনি অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করেছিলেন এবং আল্লাহর সাহায্যে মৃতদের জীবিত করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।

যেভাবে আল-কোরআনে বলা হয়েছে, আর তিনি তাকে বানী ইসরাঈলের নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করবেন’। সে বলবে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিদর্শনসহ তোমাদের নিকট এসেছি, আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখীর মত একটা কায়া গঠন করব, অতঃপর তাতে ফুঁৎকার দেব, ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখি হয়ে যাবে এবং আল্লাহর হুকুমে আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করব ও আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবিত করব এবং আমি তোমাদেরকে বলে দেব তোমাদের গৃহে তোমরা যা আহার কর এবং সঞ্চয় করে রাখ; নিশ্চয়ই এ কাজে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মু’মিন হও।’ (কোরআন ৩:৪৯)

বাইবেল তাঁর অলৌকিকতার বিষয়ে কোরআনের সাথে একমত কিন্তু তাতে এটা উল্লেখ করা নাই যে তিনি দোলনায় কথা বলেছিলেন, বা এটি উল্লেখ করে না যে যীশু মাটির তৈরি একটি পাখিকে ফু দিয়ে জীবিত পাখিতে পরিণত করেন। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যীশুর ক্রুশে শহীদ হওয়ার মাধ্যমে তাদের যাবতীয় পাপ আগেই ক্ষমা করা হয়েছে। (বাইবেল, রোমানস ৪:২৫)।

মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে ঈসা (আ.) এর মতো দেখতে একজন ব্যক্তিকে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল। মুসলিমরা আরোও বিশ্বাস করে যে কেউ অন্য ব্যক্তির পাপের জন্য দায়ী হতে পারে না।

এ বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, "তারা তাকে হত্যা করেনি বা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেনি, কিন্তু তারা ভেবেছিল তারা তা করেছে।" (কোরআন ৪:১৫৬)।

আমাদের মুসলিম পরিচয় উদযাপন করুন
শিশুদের মুসলিম হওয়ার জন্য গর্বিত হতে সাহায্য করার একটি উপায় হল তাদের জানাতে হবে যে আলাদা হওয়াতে কোনো ভুল নেই। ক্রিসমাসের বিষয় সমূহ কিছু বাচ্চাদের কাছে কোন কিছু বাদ পড়া বোধ করায়, কিন্তু যখন বাবা-মা তাদের এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শিকড় সম্পর্কে তাদেরকে শিক্ষিত করে এবং তাদেরকে হযরত ঈসা মসিহের বার্তা সম্পর্কে আরও জানায়, তখন তারা তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে সচেতন হবে, এবং এটাই তাদের পরিচয়। তাদেরকে অল্প বয়সে ঈসা (আ.) সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া এবং খ্রিস্টান ও মুসলিমদের বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য জানালে তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে এই পার্থক্য সমূহ সম্পর্কে লোকেদেরকে বলার ক্ষমতা নিয়ে শক্তিশালী হবে। আপনার সন্তানদের গর্বিতভাবে বলতে উত্সাহিত করুন, "আমি একজন মুসলিম"। অবশেষে, আপনার সন্তানকে জানতে দিন যে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক অনুশীলনকারী খ্রিস্টানরা সত্যিই বড়দিন উদযাপন করে না।

অনুবাদ : তারেক হাসান

সূত্র : এ্যাবাউট ইসলাম

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


পরিবার ও জীবন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


বিয়ে নানাভাবে আমাদের জীবনে ভূমিকা রাখে। এমনকি এটা আমাদেরকে সুখী করে, প...

পরিবার ও জীবন | 2021-09-13 20:28:40

আসসালামু আলাইকুম,আমার ১৫ বছরের ভাই হস্তমৈথুন আসক্ত যা সে আরো আগে থেকেই...

পরিবার ও জীবন | 2017-09-15 00:22:34

আধুনিক মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাবা-মেয়ের সম্পর্কের একটি ব...

পরিবার ও জীবন | 2018-01-29 10:11:48

‘মা, আপনি কেন আমার ঘরে ঢোকার আগে দরজায় নক করেন না?’ এই প্রশ্নটি অনেক...

পরিবার ও জীবন | 2020-10-13 23:55:17

অনেক মুসলিম মনে করেন, যৌন আকর্ষণ অনুভব করাটাই পাপের কাজ।  আমার পিতা বল...

পরিবার ও জীবন | 2017-12-31 11:16:02

বিয়ে করতে গেলে তিনটি পর্ব বা তিনটি সময় অতিক্রম করতে হয়। এক – খিতবাহ ব...

পরিবার ও জীবন | 2017-11-25 21:48:23

আমাদের বেড়ে ওঠার পেছনে আমাদের বাবা ও মায়ের যথেষ্ট পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বী...

পরিবার ও জীবন | 2021-08-28 20:47:20

গর্ভের সন্তানের সাথে কথা বললে একেবারে শুরু থেকেই সন্তান ও মায়ের মাঝে এ...

পরিবার ও জীবন | 2017-12-14 10:21:19