৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
মঙ্গলবার

নিশ্চয় আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। (আল কোরআন, আয়াত ১৩:১১)

ইমাম হাসান আল-বান্নার ইসলামি সমাজনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

হাসান আল-বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) ছিলেন একজন প্রখ্যাত মিসরীয় ইসলামী পণ্ডিত, সমাজ সংস্কারক এবং ইসলামী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের (ইখওয়ানুল মুসলিমিন) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইসলামী চিন্তাধারায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন এবং ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারাজীবন কাজ করে গেছেন।

হাসান আল-বান্নার জন্ম ১৯০৬ সালে মিসরের মাহমুদিয়া শহরে। তার পরিবার ছিল ধর্মপ্রাণ এবং পিতাও একজন ধর্মীয় পণ্ডিত ছিলেন। পিতার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় এবং ছোটবেলা থেকেই ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। ১৯২৩ সালে তিনি কায়রোতে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ইসলামি দর্শন ও শরিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেন।

আল-বান্না সমাজের অবক্ষয় এবং পশ্চিমা প্রভাব থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে ইসলামী জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজ গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯২৮ সালে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী ইসলামী সংগঠন হয়ে ওঠে। মুসলিম ব্রাদারহুডের লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজে ইসলামী আইন ও নীতির ভিত্তিতে সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।

১৯৪৯ সালে কায়রোতে একটি ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকাণ্ডে তিনি নিহত হন। মৃত্যুর পরও তার শিক্ষা ও আদর্শ মুসলিম সমাজে গভীর প্রভাব ফেলতে থাকে।

হাসান আল-বান্নার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ

হাসান আল-বান্না বেশ কিছু মূল্যবান বই ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যা ইসলামের শিক্ষা, সমাজ সংস্কার এবং ইসলামী রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা নিয়ে রচিত। তার লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং মুসলিম জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

১. মজমু‘ রাসায়েল (রচনাবলী সংকলন) – এটি হাসান আল-বান্নার বিভিন্ন চিঠি ও বক্তব্যের সংকলন, যা তার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করে। এই সংকলনে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তার আদর্শ, ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধ এবং রাজনীতির উপর তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে।

২. আল-ইমান ওয়াল-ইসলাম – এই গ্রন্থে তিনি ঈমান, ইসলাম, এবং ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি ইসলামী দর্শন ও জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩. দাওয়াতুনা (আমাদের দাওয়াত) – এই গ্রন্থে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের দাওয়াহ কার্যক্রম এবং ইসলামী জীবনধারায় ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

৪. ইসলামিক সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল থট – এই বইয়ে তিনি ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং কিভাবে ইসলামের নীতি ও আদর্শ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা তুলে ধরেছেন।

৫. দাওয়া ইলাল্লাহ – এই বইয়ে তিনি ইসলামের দাওয়াতি কাজ এবং মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের প্রয়োজনীয়তা ও উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

হাসান আল-বান্নার লেখার ভাষা ছিল সরল, সহজবোধ্য এবং প্রভাবশালী। তার রচনায় ইসলামী চেতনা, ঐতিহ্য এবং মুসলিম সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ রয়েছে। ইসলামের গভীর উপলব্ধির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদেরকে একতাবদ্ধ করার আহ্বান জানান এবং ইসলামী সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের নিজেদের জীবন ইসলামের মূল আদর্শ অনুযায়ী গড়ে তুললে তারা উন্নতি করতে পারবে।

হাসান আল-বান্না ছিলেন মুসলিম জাগরণের এক অনন্য নেতা এবং ইসলামী সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী চিন্তাবিদ। তার চিন্তাভাবনা ও দর্শন মুসলিম সমাজের সংস্কারে ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। তার গ্রন্থসমূহ ইসলামী জীবনব্যবস্থা ও সমাজের প্রতি সচেতন পাঠকদের জন্য আজও দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

সাম্প্রতিক পোষ্ট

পোষ্টটি শেয়ার করুন
Scroll to Top