আয়েশা স্টেসি
“যখন সততা হারিয়ে যাবে, তখন তোমরা কেয়ামতের অপেক্ষা করবে” (আল-বুখারী)।
এই মহান বাণীটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর, যা কিয়ামতের পূর্ববর্তী সময়ের একটি চিত্র তুলে ধরে। সে সময় প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের চারপাশে সততার অভাব দেখে দুঃখিত হবে।
একবিংশ শতাব্দীতে আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে সততা একদিকে মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়, অথচ অন্যদিকে তা অবহেলিত ও অবজ্ঞাত। আমরা প্রত্যাশা করি যে, আমাদের সাথে অন্যরা সৎ থাকবে, কিন্তু একই সাথে আমরা এমন বিনোদন গ্রহণ করি যা মিথ্যা ও প্রতারণাকে উৎসাহিত করে। আমাদের অবহেলার ফলে, আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাই যে অসততা গ্রহণযোগ্য। যখন আমরা তাদের বলি ফোনে মিথ্যা বলতে বা সামাজিক আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে অজুহাত তৈরি করতে, তখন আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রতারণার বীজ বপন করি।
সততা সত্যবাদিতা ও নির্ভরযোগ্যতার সমষ্টি। এটি কেবল নির্ভুলতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি নৈতিকতার একটি ভিত্তি। ইসলাম সত্যবাদিতাকে উৎসাহিত করে এবং মিথ্যাচারকে নিষিদ্ধ করে। আল্লাহ মুসলমানদের সততার প্রতি অনুগত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
প্রখ্যাত কুরআন পণ্ডিত ইবনে কাসির ব্যাখ্যা করেছেন: “সত্যবাদী হওয়া এবং সত্যবাদিতার প্রতি আনুগত্যের অর্থ হল, আপনি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন। এটি আপনার সমস্যার সমাধানের পথ তৈরি করবে।”
একজন প্রকৃত মুমিন, যিনি আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছেন, তাকে সততার মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। রাসূল (সা.) সততার জীবন্ত উদাহরণ ছিলেন। নবুওয়াতের আগেই তিনি “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত) ও “আস-সাদিক” (সত্যবাদী) উপাধি অর্জন করেছিলেন।
একবার তিনি মক্কার জনগণকে একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “হে মক্কাবাসী! যদি আমি বলি যে পাহাড়ের আড়াল থেকে তোমাদের উপর একটি সেনাবাহিনী আক্রমণ করছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?”
তারা সবাই একসাথে বলল:“হ্যাঁ, কারণ আমরা তোমাকে কখনও মিথ্যা বলতে শুনিনি।”
রাসূল (সা.) এর শত্রুরাও তাঁর সততার সাক্ষ্য দিয়েছে। বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন আবু সুফিয়ানকে রাসূল (সা.) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তখন তিনি বলেন:
“তিনি মিথ্যা বলেন না এবং অন্যদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন না। তিনি মানুষকে একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করতে বলেন এবং আমাদেরকে নামাজ, সততা ও বিরত থাকার নির্দেশ দেন।”
একজন মুসলিমের জীবনে সততার ভূমিকা অপরিসীম। এটি আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং মানবিক সম্পর্কের ভিত্তি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক জীবন, সামাজিক যোগাযোগ, সর্বত্রই সততা অপরিহার্য। ইসলামী সমাজ সততা ও ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে প্রতারণার কোনো স্থান নেই।
রাসূল (সা.) সততার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন:“সত্যবাদ ধার্মিকতার দিকে নিয়ে যায়, এবং ধার্মিকতা জান্নাতে নিয়ে যায়। একজন মানুষ সত্যবাদী হয়ে ওঠা পর্যন্ত সত্য বলতে থাকে। মিথ্যা পাপ ও মন্দ কাজের দিকে পরিচালিত করে, আর পাপ (জাহান্নাম) আগুনের দিকে নিয়ে যায়। একজন মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে যতক্ষণ না তাকে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে লেখা হয়।” (আল-বুখারী)
একটি ইসলামী সমাজে সততা ও ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যবসায়িক লেনদেনে সততার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এবং রাসূল (সা.) মুসলমানদের সর্বদা সততা বজায় রাখার উপদেশ দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর একবার কিছু বন্ধুদের সঙ্গে বসে নিম্নলিখিত আয়াত পাঠ করছিলেন:“যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য ধিক! যারা যখন মানুষের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য গ্রহণ করতে হয়, তখন তারা পূর্ণ পেতে চায়, কিন্তু যখন তারা অন্যদের তাদের প্রাপ্য দেয়, তখন তারা কম দেয়। তারা কি জানে না যে, তাদের এক মহা দিনে পুনরুত্থিত হতে হবে? যেদিন সকল মানুষ সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়াবে?” (সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১-৬)
এই আয়াত পাঠ করার পর, আবদুল্লাহ এত কেঁদেছিলেন যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তার সততা ও আল্লাহভীতি তাকে কাঁদিয়েছিল, যদিও তিনি নিজেই ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও বিশ্বস্ত।
সততা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং বিশ্বাসীদের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। কুরআন এবং হাদীস মানুষকে সততা শেখায় এবং তাদের নৈতিকতা সুদৃঢ় করে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের সততা ও সত্যবাদিতার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন:“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে।” (মুসলিম)
আয়েশা স্টেসি ২০০২ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী পাঁচ বছর কাতারের দোহায় ইসলাম অধ্যয়ন ও ফানার কালচারাল সেন্টারে কাজ করেন। ২০০৬ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান এবং ব্যাচেলর অব আর্টস এ স্নাতক সম্পন্ন করেন। আইশা একজন প্রসিদ্ধ লেখিক, যিনি ইন্টারনেট এবং মুদ্রণ মাধ্যম উভয় ক্ষেত্রেই লিখেছেন। ২০০৯-১০ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার একটি জাতীয় ইসলামিক সংবাদপত্র Crescent Times-এর কুইন্সল্যান্ড সম্পাদক ছিলেন।
সূত্র: এ্যাবাউট ইসলাম