রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা

ইসলামী বার্তা ডেস্ক

সিয়ামের প্রকৃত উদ্দেশ্য: অন্তরের পরিশুদ্ধি ও মুত্তাকী হওয়ার পথ
রামাদান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও তাকওয়া অর্জনের এক অনন্য সুযোগ। এটি শুধুমাত্র উপবাসের মাধ্যমে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা অনুভব করার নাম নয়; বরং এটি এমন একটি ইবাদাত যা মানুষকে তার নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে শেখায় এবং তাকে মুত্তাকী হওয়ার পথে পরিচালিত করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক সময় আমরা মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ফিকহি মতপার্থক্য নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ি। যেমন, তারাবীহ ৮ রাকাত না ২০ রাকাত হওয়া উচিত, মুনাজাতে হাত তোলা উচিত কিনা—এসব নিয়ে মতভেদ চলতেই থাকে। অথচ ইসলামের মূল শিক্ষা হলো অন্তরের পরিশুদ্ধি, ইবাদাতের মাধ্যমে আত্মার উন্নতি এবং কোরআনের শিক্ষাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা।

সিয়ামের প্রকৃত লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন:
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। এটি কেবলমাত্র উপবাস থাকার অনুশীলন নয়; বরং এটি আমাদের আত্মসংযম শেখায়, লোভ ও পাপাচার থেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথ প্রশস্ত করে।

কোরআনের অর্থ বোঝা ও তা জীবনে বাস্তবায়ন করা:
রামাদান শুধু উপবাসের মাস নয়, বরং এটি কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাসও। কিন্তু আমরা কি কোরআনের অর্থ বোঝার চেষ্টা করি? শুধু তেলাওয়াত করলেই কি আমরা সঠিকভাবে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবো?
কোরআন এমন একটি গ্রন্থ যা আমাদের জন্য পথনির্দেশিকা। এটি শুধুমাত্র পাঠের জন্য নয়, বরং বোঝার ও অনুসরণের জন্য এসেছে। তাই, সিয়ামের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল করতে হলে আমাদের উচিত কোরআনের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা।

ইবাদাতের মূল লক্ষ্য  আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক উন্নতি:
ইবাদাত শুধুমাত্র বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এর মূল লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধি। আমাদের নামাজ, রোজা, দান-সদকা, তারাবীহ ইত্যাদি ইবাদাত যদি আমাদের চরিত্রের উন্নতি না ঘটায়, তাহলে এসব ইবাদাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:”অনেক রোজাদার আছে, যাদের উপবাসের দ্বারা কিছুই লাভ হয় না, শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছাড়া।” (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৬৯০)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শুধুমাত্র উপবাস থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং মনের শুদ্ধতা, অন্যের প্রতি সদয় হওয়া এবং আমাদের কথাবার্তা ও আচরণে সংযম থাকা আবশ্যক।

ফিকহি বিতর্ক নয়, মূল উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি
আমরা প্রায়শই ইসলামের বাহ্যিক দিক নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কেউ বলে তারাবীহ ৮ রাকাত, কেউ বলে ২০ রাকাত। কেউ মুনাজাতে হাত তোলে, কেউ তোলে না। এসব বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে মূল ইবাদাত থেকে মনোযোগ সরে যায়। অথচ রাসূল (সা.) আমাদের বিতর্ক নয়, ঐক্যের শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো আত্মশুদ্ধি, অন্যের প্রতি সদয় হওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। বিতর্কের মাধ্যমে আমরা যদি নিজেদের অন্তরকে কলুষিত করি, তাহলে আমাদের রোজা ও ইবাদাত কোনো কাজে আসবে না।

সিয়ামের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো অন্তরের পরিশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জন। এটি আমাদের চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ দেয়, কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ করে দেয় এবং আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি পৌঁছানোর পথ দেখায়। তাই আমাদের উচিত বাহ্যিক বিতর্ক ও মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মশুদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করা, কোরআন বোঝা এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করা। তাহলেই আমরা প্রকৃত অর্থে রামাদান ও সিয়ামের উদ্দেশ্য সফল করতে পারবো।

রোজা নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা:
বাংলাদেশি মুসলিম সমাজে রোজা নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে, যা ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি মিল খায় না। এখানে কিছু সাধারণ ভুল ধারণা তুলে ধরা হলো:

১. মিসওয়াক বা টুথপেস্ট ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যায়:
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, রোজা অবস্থায় মিসওয়াক বা টুথপেস্ট ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
সঠিক ব্যাখ্যা: রাসূল (সা.) রোজার সময় মিসওয়াক ব্যবহার করেছেন। তবে টুথপেস্টের স্বাদ ও ফেনা গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যেতে পারে, তাই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

২. ইঞ্জেকশন নিলে রোজা ভেঙে যায়:
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, ইনজেকশন নিলে রোজা ভেঙে যায়।
সঠিক ব্যাখ্যা: পুষ্টিকর বা শক্তি বাড়ানো ধরনের ইনজেকশন (যেমন গ্লুকোজ) নিলে রোজা ভেঙে যায়, কিন্তু সাধারণ ওষুধের ইনজেকশন রোজার জন্য ক্ষতিকর নয়।

৩. সেহরি না খেলে রোজা হয় না:
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, সেহরি না খেলে রোজা হবে না।
সঠিক ব্যাখ্যা: সেহরি খাওয়া সুন্নত, তবে এটি না খেলেও রোজা হবে, যদি সুবহে সাদিকের আগে রোজার নিয়ত করা হয়।

৪. গোসল না করলে রোজা শুরু করা যাবে না:
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, যদি কেউ অপবিত্র (যানাবাত) অবস্থায় থাকে এবং ফজরের আগে গোসল করতে না পারে, তবে তার রোজা হবে না।
সঠিক ব্যাখ্যা: অপবিত্র অবস্থায়ও রোজা রাখা যায়, তবে নামাজের আগে অবশ্যই গোসল করা জরুরি।

৫. কেউ যদি ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলে, তাহলে রোজা ভেঙে যায়:
ভুল ধারণা: ভুল করে কিছু খেলে রোজা ভেঙে যায় এবং কাজা করতে হয়।
সঠিক ব্যাখ্যা: হাদিস অনুযায়ী, ভুলবশত খেলে বা পান করলে রোজা ভাঙবে না, কারণ এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক হিসেবে গণ্য হয়।

৬. মুখে থুথু জমে গেলে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যায়:
ভুল ধারণা: মুখের থুতু গিলে ফেললে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে।
সঠিক ব্যাখ্যা: সাধারণ থুতু গিলে ফেলা রোজার জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। তবে কফ বা কোনো খাবারের অংশ গিলে ফেললে সমস্যা হতে পারে।

৭. রক্ত নেওয়া বা দেওয়া রোজা ভেঙে ফেলে:
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, রক্ত দিলে বা ব্লাড টেস্ট করালে রোজা ভেঙে যাবে।
সঠিক ব্যাখ্যা: সাধারণ রক্ত নেওয়া বা দেওয়া রোজার জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করে না, তবে অতিরিক্ত রক্ত দিলে শরীর দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

৮. ইফতারের সময় আজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া যাবে না:
ভুল ধারণা: অনেকেই মনে করেন, মাগরিবের আজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইফতার করা যাবে না।
সঠিক ব্যাখ্যা: সূর্যাস্ত হওয়ার সাথেই ইফতারের সময় হয়। তাই মাগরিবের আজানের শুরুতেই ইফতার করা সুন্নত।

৯. রোজা রেখে গোসল করলে রোজা নষ্ট হয়:
ভুল ধারণা: কেউ কেউ মনে করেন, রোজার মধ্যে গোসল করলে রোজা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সঠিক ব্যাখ্যা: রোজা রেখে গোসল করা সম্পূর্ণ বৈধ, তবে পানি ভুলবশত গলার ভেতরে চলে গেলে সমস্যা হতে পারে।

১০. কান বা চোখে ওষুধ বা ড্রপ ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যায়:
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, চোখ বা কানে ড্রপ দিলে রোজা ভেঙে যাবে।
সঠিক ব্যাখ্যা: ইসলামী শরিয়ত অনুসারে, চোখ বা কানে ড্রপ ব্যবহার করলে রোজা ভাঙে না, কারণ এটি সরাসরি পাকস্থলীতে প্রবেশ করে না। তবে নাকে স্প্রে বা ওষুধ দিলে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, কারণ তা সরাসরি গলার মাধ্যমে পেটে যেতে পারে।

এ ধরনের ভুল ধারণা পরিহার করে ইসলামিক শিক্ষার সঠিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। ইসলামের মূল শিক্ষার প্রতি সচেতন থাকলে আমরা রোজাকে আরও সঠিকভাবে পালন করতে পারব।

সাম্প্রতিক পোষ্ট

পোষ্টটি শেয়ার করুন
Scroll to Top