নিশ্চয় আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। (আল কোরআন, আয়াত ১৩:১১)

২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার

ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত আবুল আ’লা মওদুদী (র.) : জীবন ও আদর্শ

আবুল আ’লা মওদুদী (র) (১৯০৩-১৯৭৯) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং মুসলিম বিশ্বে ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম প্রবক্তা। তিনি ইসলামি দর্শন, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর চিন্তাধারা এবং রচনা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এখনও মুসলিম সমাজে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

শৈশব ও শিক্ষা

আবুল আ’লা মওদুদী (র) এর জন্ম ১৯০৩ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর, ভারতের আওরঙ্গাবাদে। তাঁর পরিবার ধর্মপ্রাণ এবং শিক্ষিত ছিল। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের আগ্রহ তৈরি হয়। প্রথাগত বিদ্যালয়ে না পড়ে তিনি বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরবর্তীতে মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হন। তবে সময়ের সাথে সাথে আধুনিক বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং দর্শনের ওপরও তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তিনি পড়াশোনার জন্য দিল্লী চলে যান এবং এখানে এসেই তিনি সমসাময়িক বিশ্ব, রাজনীতি এবং ইসলামি দর্শন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।

সাহিত্য ও চিন্তাভাবনার সূচনা

তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা হয় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। তিনি “তরজমান-উল-কুরআন” নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ইসলামী ভাবধারার প্রচার শুরু করেন এবং ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তরজমান-উল-কুরআন পরবর্তীতে ইসলামি চিন্তার একটি প্রধান ভিত্তি হয়ে ওঠে এবং এটি পড়ে অসংখ্য মানুষ ইসলাম সম্পর্কে নবতর দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেন।

তিনি  তাঁর রচনার মাধ্যমে ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি মনে করতেন, ইসলাম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ও ধর্মীয় নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাঁর চিন্তাধারা ইসলামী রেনেসাঁর দিকে ধাবিত এবং ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শের দিকে লক্ষ রাখে।

জামাতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা

১৯৪১ সালে মওদুদী (র) “জামাতে ইসলামী” প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইসলামী রাজনীতির ধারায় নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করে। জামাতে ইসলামীর লক্ষ্য ছিল ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। মওদুদী এই সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক সংস্কার, রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা, এবং ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শ ও নীতি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রই পারে প্রকৃত শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে।

জামাতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি সাধারণ জনগণের মধ্যে ইসলামের আদর্শ এবং নৈতিক শিক্ষার প্রচার করতে থাকেন। তার সংগঠন সামাজিক ন্যায়, শিক্ষার প্রসার, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর জোর দেয়। জামাতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড এবং চিন্তাধারা পরবর্তীতে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।

প্রধান রচনা ও বই

তাঁর  সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে অন্যতম হলো “তাফহিমুল কুরআন”, যা একটি পূর্ণাঙ্গ কুরআনের তাফসির বা ব্যাখ্যা। এটি কুরআনের অর্থ ও মর্ম বোঝাতে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “ইসলামিক ল অ্যান্ড কনস্টিটিউশন”, “ফান্ডামেন্টালস অফ ইসলাম”, এবং “তাফহিমাত”

তাঁর রচনাগুলোতে ইসলামকে আধুনিক বিশ্বের সাথে মিলিয়ে কিভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করা যায়, সেই বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মওদুদী তার লেখায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ইসলামের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি একাধারে ইসলামের মূল নীতিমালা ও কুরআনের মর্মার্থকে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্যও সহজবোধ্য।

রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনা

তিনি ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছেন। তাঁর মতে, ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা, যা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় নেতৃত্ব ও প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জনগণের সেবা করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের শাসনব্যবস্থায় মূলত নৈতিকতা, ন্যায়বিচার, এবং সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়।

তিনি মনে করতেন যে আধুনিক সমাজের নানা সমস্যার সমাধান ইসলামি আদর্শের মাধ্যমে সম্ভব। তিনি পশ্চিমা পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে তুলনা করে দেখিয়েছেন এবং ইসলামিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন দেন। তার মতে, মুসলিম বিশ্বের উন্নতির জন্য মুসলিমদের নিজেদের আদর্শ ও ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হতে হবে এবং ইসলামের মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে সমাজ গঠন করতে হবে।

মৃত্যুবরণ ও উত্তরাধিকার

আবুল আ’লা মওদুদী (র) ১৯৭৯ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর চিন্তাভাবনা ও আদর্শ মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। মওদুদীর রচনাগুলি আজও পাঠক মহলে জনপ্রিয় এবং বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসলামি আদর্শের প্রতি অনুরাগ তৈরি করছে। তাঁর প্রবর্তিত চিন্তাধারা এবং কর্মসূচি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু ইসলামি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

আবুল আ’লা মওদুদী  (র) ছিলেন একজন প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ, যিনি ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করেছেন। তাঁর চিন্তাধারা, রচনা, এবং জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মুসলিম সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক জাগরণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম শুধুমাত্র তৎকালীন মুসলিম সমাজকে নয়, বরং আধুনিক মুসলিম প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে চলছে। তাঁর আদর্শ ও দর্শন মুসলিম উম্মাহকে একটি স্বাধীন ও উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে আজও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।

পোষ্টটি শেয়ার করুন
Scroll to Top