ছবি: আবু মোহাম্মদ আল জোলানি ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ দামেস্কে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘোষণার পর উমাইয়া মসজিদে এক সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন।
স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিজয় ভাষণে আল-জোলানি দামেস্কের ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদ থেকে বক্তব্য দেন। তিনি সিরিয়ার জনগণকে বলেন, নতুন দেশ গড়তে হবে ‘কঠোর পরিশ্রমে’।
সিরিয়ার রাজধানী দখলকারী স্বাধীনতাকামী প্রধান সংগঠন হায়াত তাহরির আল শাম (এইচটিএস) এর নেতা আল-জোলানি বলেন, যে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সিরিয়ার জনগণই দেশের “প্রকৃত মালিক” এবং এ বিজয়ের মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য “নতুন ইতিহাস” লেখা হয়েছে।
রবিবার এইচটিএস দামেস্ক দখলের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছে আল-জোলানি ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদে বিজয় ভাষণ দেন। উমাইয়া মসজিদে তার ভাষণের আগে স্থানীয় জনতা তাকে একজন মুক্তির প্রতীক হিসেবে স্বাগত জানায়।
ভোরে যখন সূর্যের আলো ফুটে উঠল, তখন সিরিয়ার জনগণ একটি নাটকীয় পরিবর্তিত দেশে ঘুম থেকে জাগল। মুক্তিকামী বাহিনী দ্রুত আক্রমণের মাধ্যমে দামেস্কে প্রবেশ করে এবং দুই যুগের বেশি সময় ধরে জগদ্দল পাথমরর মত সিরিয়ার মসনদে বসে থাকা স্বৈরাচারী বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দেয়। আসাদ ভোরের প্রথম প্রহরে সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যায় বলে রাশিয়ান মিডিয়ার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি নতুন সিরিয়া গড়তে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য আলোর বাতিঘর হবে।
-মোহাম্মদ আল-জোলানি
উমাইয়া মসজিদে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে আল-জোলানি বলেন, “আসাদের শাসন অন্যায়ভাবে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে কারাগারে আটকে রেখেছে। আমরা সিরিয়ার জনগণ এই দেশের প্রকৃত মালিক। আমরা লড়াই করেছি, এবং আজ আমরা এই বিজয়ের পুরস্কার পেয়েছি। সিরিয়ার কত মানুষ বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে? কত মানুষ তাঁবুতে বসবাস করেছে? কত মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে? তার হিসাব নেই। আমার ভাইয়েরা, এই মহান বিজয়ের পর পুরো অঞ্চলে একটি নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। একটি নতুন সিরিয়া গড়তে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে যা “মুসলিম উম্মাহর জন্য আলোর বাতিঘর” হবে।
তিনি প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই বিজয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। আল্লাহ আপনাদের ব্যর্থ করবেন না। এই বিজয় সব সিরিয়ানের জন্য; তারা সবাই এই বিজয়ের অংশ।”
ঐক্যের ওপর জোর দিলেন
এইচটিএস এবং আল-জোলানি ঐক্যের বার্তার ওপর জোর দিচ্ছে, যা তার উমাইয়া মসজিদে দেওয়া ভাষণেও প্রতিফলিত হয়েছে। লেবানন-সিরিয়া সীমান্ত থেকে আল-জাজিরার জেইন বাসরাভি বলেন, এইচটিএস নেতার ভাষণের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। “তিনি এই ধারণার ওপর জোর দিয়েছেন যে প্রতিশোধ নেওয়া উচিত নয়। সিরিয়া সব সিরিয়ানের জন্য হওয়া উচিত, এটাই জনগণের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
রবিবার দামাস্কাসে পৌঁছে আল-জোলানি প্রথমে নামাজ আদায় করেন। পরে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পাঠ করা এক বিবৃতিতে আল-জোলানি বলেন, “আমরা আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় সংকল্পে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা ২০১১ সালে শুরু করা পথ সম্পন্ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সিরিয়ার জনগণের সমস্ত অধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই বন্ধ করব না। ভবিষ্যৎ আমাদের এবং আমরা বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
রবিবারের এই জয় ১৩ বছরের নৃশংস যুদ্ধের পর আসে, যা আল-আসাদ পরিবারের অর্ধ শতাব্দীর শাসনেরও অবসান ঘটায়।
সিরিয়ার যুদ্ধ ২০১১ সালের মার্চ মাসে আল-আসাদের বিরুদ্ধে একটি মূলত নিরস্ত্র বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়। এতে বিদেশি শক্তিগুলোর জড়িত হওয়া, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং শরণার্থী হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে তিনি তার বার্তা প্রদানের জন্য দামেস্কের ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদকে বেছে নিয়েছেন। কোনো টিভি স্টুডিও বা সদ্য খালি হওয়া প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ নয়, বরং এক মহিমান্বিত ধর্মীয় স্থান ১৩০০ বছরের পুরনো এই মসজিদ বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি এবং ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
তাঁর ভাষনে সদ্য মুক্ত হওয়া সিরিয়ান জনগণের জন্যও একটি প্রতীকী বার্তা বহন করে। যাতে তিনি বলেন, “আমার ভাইয়েরা, এই বিজয় এসেছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কৃপায় এবং শহীদ, বিধবা ও এতিমদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। যারা কারাগারে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছে, তাদের কষ্টের মধ্য দিয়ে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি।”
উমাইয়া মসজিদ থেকে আল-জোলানি একটি শক্তিশালী এবং সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। তিনি একজন সুন্নি মুসলিম, যারা সিরিয়ার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। কিন্তু সিরিয়ার এই মাটি খ্রিস্টান, দ্রুজ, শিয়া, সুন্নী সহ সকল মুসলিম এবং ইসমাইলি সম্প্রদায়েরও আবাসস্থল। সবাই এই বিজয়ের অংশীদার
তবে এই ভাষণ শুধুমাত্র সিরিয়ানদের জন্য নয়, এটি ছিল আন্তর্জাতিক মহলের জন্যও। এটি এমন একটি বার্তা যা ইরায়েলের তেল আবিব এবং ওয়াশিংটনে পৌঁছাবে, যেখানে জোলানি এখনও একটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা হিসেবে চিহ্নিত এবং যার মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার। তার এই বার্তা আরো বলা হয় নতুন সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হবে।