ইসলামী বার্তা ডেস্ক

গাজার যুদ্ধ: মানবতার সংকট ও অনুতপ্ত সৈনিকদের বর্ণনা
প্রতিটি যুদ্ধই একেকটি বিভীষিকাময় গল্প—কিছু বীরত্বের, কিছু নির্মমতার। কিন্তু গাজার বর্তমান বাস্তবতা শুধুই মৃত্যু ও নৃশংসতার উপাখ্যান। বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গাজায় মোতায়েন ইসরায়েলি সেনাদের বিবরণ, যা বিশ্ব ইতিহাসের সব বর্বরতাকেই হার মানিয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর যুদ্ধে যোগ দেন ২৬ বছরের ইসরায়েলি যুবক ইউভাল গ্রিন। দেশের জন্য লড়াই ও হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের মুক্ত করার সংকল্প নিয়ে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের পরই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়—তিনি প্রত্যক্ষ করেন এক ভিন্ন বাস্তবতা, যা জাগিয়ে তোলে তাঁর মানবতাবোধ।
ইউভাল জানান, একদিন গাজার রাস্তায় পড়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের মরদেহের ওপর বিড়ালদের কামড়াতে দেখেন। তাঁর ভাষায়, “ডানে বা বামে তাকালেই শুধুই ধ্বংসস্তূপ, আগুনের লেলিহান শিখা—এটাই গাজার বাস্তবতা।” কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইসরায়েলি নেতাদের মুখে শোনেন গণহত্যার আহ্বান। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ডেপুটি স্পিকার নিসিম ভাদুড়ি গাজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার কথা বলেন, আর প্রখ্যাত ইহুদি ধর্মগুরু এলিয়াহু মালিও একই সুরে বলেন, “তুমি যদি তাদের হত্যা না করো, তারা তোমাকে হত্যা করবে।”
ইউভাল জানান, গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা যেন ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সেনাই প্রতিশোধের আগুনে উন্মত্ত হয়ে চরম নৃশংসতার পথ বেছে নিয়েছে। তবে এই অমানবিকতা দেখে অনেক সেনাই নিজেদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একজন অজ্ঞাতনামা ইসরায়েলি সেনা জানান, গাজায় নিরীহ মানুষদের ওপর নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনায় অনেক সেনা গর্ববোধ করত। তাদের কাছে এটি ছিল যেন দৈনন্দিন জীবনের এক স্বাভাবিক ঘটনা। বন্দিদের এমনভাবে চোখ বেঁধে রাখা হতো যাতে তারা নড়াচড়া করতে না পারে, আর খাবার দেওয়া হতো অমানবিকভাবে।
২৯ বছর বয়সী মাইকেল অফার-জিব, যিনি ড্রোন ক্যামেরায় যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করতেন, সরাসরি গাজায় গিয়ে এক ভয়াবহ বাস্তবতার সম্মুখীন হন। তিনি জানান, গাড়ির জানালা খুলতেই এমন এক তীব্র গন্ধ পান, যেন তিনি মাংসের বাজারে দাঁড়িয়ে আছেন। রাস্তায় পড়ে থাকা শরীরের টুকরো দেখে তিনি শিউরে ওঠেন। তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে—তিনি স্বচক্ষে দেখেন, আত্মসমর্পণ করতে আসা তিন ইসরায়েলি জিম্মিকে তাঁর সহকর্মী সেনারা গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার পর মাইকেল নিজেকেই প্রশ্ন করতে বাধ্য হন—তাঁরা আদৌ কোন নৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসরায়েলি বাহিনীর এই নৃশংসতার মূলে রয়েছে সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান ধর্মীয়করণ। সামরিক বাহিনীতে চরমপন্থী ইহুদি জাতীয়তাবাদীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, ফলে সেনাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তে ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদের চেতনা বপন করা হচ্ছে। এর ফলেই তৈরি হচ্ছে এক নিষ্ঠুর ও নীতিহীন বাহিনী।
যুদ্ধ কখনোই মানবতার জন্য আশীর্বাদ নয়। গাজায় যা ঘটছে, তা তারই নির্মম উদাহরণ। যে সেনারা একসময় দেশ রক্ষার স্বপ্ন দেখেছিল, তারাই আজ অনুতাপ ও বিভ্রান্তির ভারে জর্জরিত। কারণ এই যুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ড দখলের জন্য নয়—এটি মানবতা, নৈতিকতা ও রাজনীতির এক গভীর সংকট। প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ যেন একটাই প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে—এই সহিংসতা কি কখনও শেষ হবে?