হানা আলাসরি : ১৫ নভেম্বর, ২০২৪
হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর (অন্যদের সাথে) অবিচল থাকো, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা (তোমাদের) পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও হয়। ব্যক্তি ধনী হোক বা দরিদ্র, উভয়ের জন্য আল্লাহই সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং ন্যায়বিচার করার জন্য কখনও প্রচলিত প্রথা অনুসরণ করবে না; আর যদি তুমি বাঁকা হও বা সরে যাও, তবে তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বদাই সম্যক অবগত।
আজ আমরা যে অবিচার দেখছি তা অপ্রতিরোধ্য। কোন জায়গাই জুলুম অবিচার থেকে মুক্ত নয়। ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া এখন আমাদের ভুলগুলিকে প্রত্যক্ষ করিয়ে দেয়, যে এটি কতটা ঠিক। নিরুৎসাহিত করার কাজটা সহজ। তাই, আসুন এই মহান ও পবিত্র ন্যায়বিচার সম্পর্কে নিজেদেরকে প্রশিক্ষিত করে শুরু করি। যে শিক্ষা রয়েছে সূরা আল-কাসাসে বর্ণিত মুসা (আঃ) এর কাহিনী থেকে।
শিক্ষা-১: জুলুমকারী মানুষকে বিভক্ত করে নিপীড়নের উদ্দেশ্যে
নিশ্চয়ই, ফেরাউন দেশে নিজেকে উন্নীত করেছিল এবং সেখানকার লোকদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল, তাদের একটি অঞ্চলে অত্যাচার চালিয়েছিল, তাদের নবজাতক পুত্রদের হত্যা করেছিল এবং তাদের কন্যাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। নিঃসন্দেহে সে ছিল বিপর্যয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আল-কাসাস : আয়াত ৪)
“বিভক্ত কর এবং জয় কর” অপশাসনের জন্য এটি শুধুমাত্র একটি অভিনব বাক্যাংশ নয়। এটি একটি কৌশল যা ইতিহাসবিদরা শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে গবেষণা করেছেন। এটি সফলভাবে ভূমি উপনিবেশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, এটি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এটি ট্রান্সআটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এই আয়াতটি শুধু এটা ব্যাখ্যা করে না যে ফেরাউন কতটা কুৎসিত ছিল। এই আয়াতটি একটি জনগোষ্ঠির উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারের পূর্বশর্তের একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে। আমরা যদি এর লক্ষণসমূহ তাড়াতাড়ি চিনতে পারি, তাহলে ন্যায়ের লড়াইয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে বিজয়ী থাকার থাকার সুবিধা আমাদের থাকবে।
দুর্ভাগ্যবশত, এই ধরনের বিভাজনের ছলনাময় কিছু রূপের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে অন্যায়কে প্রতিহত করা এবং এমনকি ন্যায়সংগত কাজ করা সহজ হয় না। ম্যালকম এক্স একবার বলেছিলেন “যদি আপনি সতর্ক না হন তবে সংবাদপত্র আপনাকে নিপীড়িত লোকদের ঘৃণা করা শেখাবে এবং যারা নিপীড়ন করছে তাদের ভালবাসতে শেখাবে।”
শিক্ষা-২: সঠিক কাজটা করা কখনও কখনও কঠিন
আর মূসার মায়ের হৃদয় সব কিছুর মধ্যে শূন্য হয়ে গেল। তিনি তার বিষয়টি প্রকাশ করে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি তার হৃদয়কে দৃঢ় রাখলাম, যাতে সে মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (সূরা আল-কাসাস: আয়াত ১০)
সঠিক কাজটি করা কষ্টকর, বিশেষ করে একমাত্র আপনিই যদি এটি করেন। এমনকি মুসার মা, যাকে আল্লাহ আশ্বস্ত করেছিলেন যে মুসার যত্ন নেওয়া হবে, তবুও তার এ বিষয়ে প্রচুর অসুবিধা হয়েছিল।
সঠিক জিনিসটি করা কঠিন, তবে এটি সঠিক। আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়াতে সহজ করার প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি আমাদেরকে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরকালে এর জন্য পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তাই আপনার বন্ধুকে পরামর্শ দিন যদিও আপনি ভয় পান সে কি বলবে। আপনি যদি মনে করেন যে আপনি কোনও পার্থক্য করছেন না তখনও দান করুন। নিজেকে প্রশিক্ষিত করুন এমনকি যদি আপনিই এটি করছেন! এটা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তাহলে তা এই দুনিয়াকে আরও ভালো করে দেবে এবং অন্যদের জন্যও ভালো করবে!
শিক্ষা-৩: ন্যায়বিচারের জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন
এবং তিনি শহরের লোকদের অমনোযোগী সময়ে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে দুই ব্যক্তিকে যুদ্ধরত দেখতে পেলেন: একজন তার দল থেকে এবং একজন তার শত্রুদের মধ্য থেকে। এবং তার দলের একজন তার শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে সাহায্যের জন্য ডাকে, তাই মূসা তাকে আঘাত করে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে। মূসা বললেন, এটা শয়তানের কাজ। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকাশ্য ও বিভ্রান্তকারী শত্রু।” মূসা বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি, তাই আমাকে ক্ষমা করুন, এবং তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (আল-কাসাস ২৮: ১৫-১৭)
আবেগ বিচারের কোন অংশ নয়। বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধৈর্য এবং প্রজ্ঞা।
একটি কর্মের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, আপনি কী বলতে এবং করতে চলেছেন তা ভেবেচিন্তে মূল্যায়ন করুন। উভয় পক্ষকে না বুঝে কোনো বিষয়ে পক্ষ নেওয়া ইসলামি নিয়ম নয়। অনিয়ন্ত্রিত রাগ এবং আবেগ দ্বারা চালিত তাড়াহুড়ো সিদ্ধান্ত একটি ন্যায়সঙ্গত বিচারে সাহায্য করে না। এর পরিণতি ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে শয়তান আপনার তাড়াহুড়ার সুযোগ না নেয়।
এই আয়াত সমূহে, আমরা দেখতে পাই যে কেউ যখন দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং চরম ক্রোধকে লাগামহীন ভাবে চালিয়ে দেয় তখন কী ঘটতে পারে। এর ফলে কারো মৃত্যু ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত মুসা (আ.) কে শহর থেকে পালিয়ে যেতে হয়।
কারো প্ররোচনায় কাজ করলে সঠিক তদন্ত ছাড়াই কোন পক্ষ নিতে হয়, পক্ষ নেওয়ার জন্য এটি অত্যন্ত লোভনীয়, কারণ কে সত্য বলছে সে সম্পর্কে আমাদের দৃঢ় অনুভূতি রয়েছে। কিন্তু ধৈর্য ও প্রজ্ঞার অনুশীলন ও ভুল থেকে বেচে থাকার জন্য এবং পাপ থেকে রক্ষা পেতে এটা করণীয়। আমি জানি আমি ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভুল করছি। এভাবে আমি পাপ করেছি কারণ আমি ভুল ভেবেছিলাম বা কাউকে এমন কিছু করার জন্য অভিযুক্ত করেছি যা তারা করেনি। তারপর আমাকে লজ্জাজনক ভাবে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল এবং তওবা করতে হয়েছিল। পক্ষ নেওয়ার আগে আমি যদি প্রথমে প্রশ্ন করতাম, তাহলে আমি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতাম না। ইসলামিক আদালতের বিচারকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে তারা আবেগপ্রবণ অবস্থায় কখনই রায় দেবেন না। তারা দুঃখী, রাগান্বিত বা এমনকি ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও রায় দেবেন না।
উপসংহার
মানুষ তাদের স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ। তিনি আমাদেরকে এই পৃথিবীতে ন্যায়বিচারের পদ্ধতি বলে দিয়েছেন সমগ্র কুরআন এবং সহীহ সুন্নাহর মাধ্যমে। একজন মুসলিম আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখে “যদিও তা তার নিজের বা তার পিতামাতা এবং নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও হয়।” এবং পরকালেই হবে সবচেয়ে নিখুঁত ন্যায়বিচার।
লেখিকা: হানা আলাসরি
হানা আলাসরি মেডিসিন বিষয়ে একজন চিকিৎসা সহযোগী, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্র্যাকটিস করছেন। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর রয়েছে ইসলামি কমিউনিটি আয়োজনের অভিজ্ঞতা। তিনি SALIM Life LLC এর প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর একটি স্ব-উন্নত ব্র্যান্ড রয়েছে যা খোদা-সচেতনতা ও স্ব-উন্নতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। বিবাহপূর্ব প্রস্তুতি এবং দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা নিরাময়ে তাঁর বিশেষ দক্ষতা রয়েছে এবং ব্যক্তিগত কোচিং, গ্রুপ কোচিং, ওয়ার্কশপ এবং আরও অনেক ভাবে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তাঁর সোশাল মিডিয়া সাইট সমূহ থেকে hanaalasry.com, Tiktok (@HanathePA) এবং Youtube (Hana Alasry) থেকে তাঁর কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
সূত্র: এ্যাবাউট ইসলাম