নিশ্চয় আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। (আল কোরআন, আয়াত ১৩:১১)

২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার

ইসলামী বিশ্বের বিজ্ঞান নীতি: অতীতের ঐতিহ্য ও বর্তমানের চ্যালেঞ্জ

ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞান এবং গবেষণার গুরুত্ব সবসময়ই অত্যন্ত উচ্চ স্থানে ছিল। ইতিহাসে দেখা যায় যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিজ্ঞানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং সেই যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তত্ত্বের মাধ্যমে মানব সভ্যতায় অবদান রেখেছেন। তবে বর্তমান ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি মনোযোগ ও নীতির প্রয়োগ বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে।

ইসলামে বিজ্ঞান ও জ্ঞানের গুরুত্ব

ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বারবার মানুষকে সৃষ্টিজগতের সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং তার রহস্য উদ্ঘাটনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসলাম বলে, স্রষ্টার সৃষ্টি সম্পর্কে জানা এবং সেই জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহর কুদরতকে উপলব্ধি করা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব। এ কারণেই প্রাচীন মুসলিম বিজ্ঞানীরা যেমন আল-কিন্দি, আল-খারিজমি, ইবনে সিনা, আল-বিরুনিরা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

ইসলামী বিশ্বের বর্তমান বিজ্ঞান নীতি

ইসলামী বিশ্বের বর্তমান বিজ্ঞান নীতি এবং গবেষণায় বিনিয়োগ অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে। কিছু দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ালেও অনেক দেশ এখনো পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয় না। নিচে ইসলামী বিশ্বের বিজ্ঞান নীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

১. গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের অভাব

বেশিরভাগ মুসলিম দেশে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য (R&D) পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা হয় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অর্থায়নের অভাবের কারণে গবেষণা কার্যক্রম সীমিত হয়ে যায়। এটি বিশ্বমঞ্চে মুসলিম দেশগুলোকে পিছিয়ে রাখছে এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ করছে।

২. শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান মনস্কতার অভাব

ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞান শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিতের (STEM) প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় আগ্রহী হলেও পরিপূর্ণ সুযোগ পান না।

৩. ইসলামের জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ

ইসলামিক দর্শনে বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। ইসলামে বিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিশ্বের অধ্যয়ন হিসেবে দেখা হয় যা মানুষকে আল্লাহর প্রতি আরও গভীর উপলব্ধি প্রদান করে। তবে বর্তমানে ইসলামী বিশ্বের অনেক স্থানে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে একটি ভিন্নতার ধ্যানধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে বাধাগ্রস্ত করে।

৪. আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সাথে সহযোগিতা

বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং সহযোগিতা করা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও কিছু দেশ এই পথে এগিয়েছে, তবে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে এই প্রবণতা এখনও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি।

৫. সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব

ইসলামি সংস্কৃতিতে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন মুসলিম বিজ্ঞানীদের মতো বর্তমান প্রজন্মকেও সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ধারণা অনুসন্ধানের জন্য উৎসাহিত করা প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামী বিশ্বের বিজ্ঞান নীতি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে উন্নত হয়নি। তবে অতীতে ইসলামি বিশ্ব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তা অনুপ্রেরণামূলক। ভবিষ্যতে ইসলামী বিশ্ব বিজ্ঞান ও গবেষণায় আরও বেশি গুরুত্ব দিলে এটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। ইসলাম সবসময় জ্ঞানকে সম্মান করেছে এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে চলতে পারলে ইসলামী বিশ্ব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আবারও উন্নতি অর্জন করতে পারে।

পোষ্টটি শেয়ার করুন
Scroll to Top