শিয়াবে আবু তালিবে বন্দি অবস্থায় রাসূল (সা.) এর তিন বছর


ইসলামী বার্তা ডেস্ক
Published: 2021-06-24 04:03:23 BdST | Updated: 2024-04-20 12:44:41 BdST

আমরা কোনো কঠিন মূহুর্ত বা বিপদের সম্মুখীন হলে খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ি। আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাগুলোর সময় আমরা ধৈর্য ধারণ করতে ব্যর্থ হই! রাসূল (স.) এর তিন বছরের অবরুদ্ধ জীবন সম্পর্কে জানলে আমাদের ছোট ছোট কষ্টগুলো আর কষ্টই মনে হবে না। মহানবী (স.) শিয়াবে আবু তালিবে ত্যাগ-তিতিক্ষার একটি অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।  

নবী (স.) এর নবুয়ত লাভের কিছুদিন পরই আমীর হামযা (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ) এর মতো সম্মানিত ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে কুরাইশদের ক্রোধ, ক্ষোভ ও অভিমান  প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। ফলে তারা মুসলমানদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে। এ সভায় অনেক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর তারা সকলে ঐকমত্য পোষণ করে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করে।  তাদের ধারণা ছিল মুত্তালিব ও হাশিম গোত্রের সহযোগিতাই মুহাম্মদ  (স.) এর শক্তির উৎস। তাই তারা মুসলমানদেরকে এবং এ দুটি গোত্রকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন ও  একঘরে করে রাখার উদ্দেশ্যে এ চুক্তিনামায় সাক্ষর করে তা কাবা শরিফের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়। এ চুক্তিনামার লেখক মনসুর ইবনে ইকরামার হাত পরবর্তীতে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। মুহাম্মদ (স.) কে হত্যা করার জন্য স্বেচ্ছায় কুরাইশদের কাছে সমর্পণ না করা পর্যন্ত এ চুক্তি জারী থাকবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও এতে হাশিম ও মুত্তালিব গোত্রের লোকেরা বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। আবু তালিব ঘোষণা করেন, 

“এ মসজিদের মালিকের শপথ! আহমদকে আমরা কখনো তাদের হাতে অর্পণ করবো না! তার সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে কালনাগিনী দংশন করলেও নয়।”

 এ চুক্তির ফলে মুহররম মাসের প্রথম চাঁদ রাতে  আবু লাহাব বাদে হাশিম ও মুত্তালিব গোত্রের অন্যান্য মুসলিম ও অমুসলিমরা বাধ্য হয়ে মক্কা থেকে বের হয়ে মুহাম্মদ (স.) এর সাথে শিয়াবে আবু তালিব নামক গিরি সংকটে আশ্রয় নেন। তারা শিয়াবে আবু তালিবে অবর্ণনীয় ক্লেশ ও দুঃখের শিকার হন। কারণ চুক্তি অনুসারে তাদের সাথে বেচা- কেনা, বিয়ে শাদি, সাহায্য সহযোগিতা,  সামাজিক লেন-দেন, কথাবার্তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। শিয়াবে আবু তালিবে বন্দি ব্যক্তিদের কোনো ধরণের সাহায্য করলেও তার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কুরাইশদের এ হঠাৎ সিদ্ধান্তের ফলে শিয়াবে আবু তালিবে কোনো ধরণের খাদ্য-শস্য বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে প্রবেশের সুযোগ ছিল না। বরং তারা যার কাছে যা আছে শুধুমাত্র তা নিয়েই গিরি সংকটে প্রবেশ করেছিলেন। ফলে কিছুদিন পরেই চরমভাবে খাদ্যের সংকট বৃদ্ধি পায়। এভাবে দিনের পর দিন এবং অনেক মাস চলে যায়। এ সময় তারা গাছের পাতা ও ছাল খেয়ে এবং শুকনো চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হয়।  শিয়াবে আবু তালিবের বাইরে থেকেও ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির হয়ে পড়া শিশু সন্তান ও  মহিলাদের কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু এতে মক্কাবাসীর কঠোর হৃদয় একটুও বিচলিত হতো না। এভাবেই দীর্ঘ তিন বছর চলে যায়। সাহাবীগণ তাদের অবস্থা সম্পর্কে বলেন,

“এ সময় আমরা গাছের পাতা সিদ্ধ করে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করতাম। পানির অভাবে ও বৃক্ষপত্র ভক্ষণের ফলে আমাদের মল ছাগলের মলের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল।”

ক্ষুধা ও অর্ধাহারের বিষাক্ত ছোবল থেকে এ সময় কেউ রক্ষা পায়নি। স্বচ্ছল ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা নিজেদের সমস্ত ধন-সম্পদ ব্যয় করে ফেলেন। খাদীজা (রাঃ) তাঁর সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করেন। এ সময় পানির অভাবে তারা অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়েছেন।  বিভিন্ন রোগও ছড়িয়ে পড়েছিলো। বেশীরভাগ মানুষই মৃত্যূর প্রায়-দ্বার প্রান্তে এসে দাড়ালেও তাঁরা ধৈর্য ও অবিচলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তাঁদের মধ্যে একজনও পশ্চাদপদ হননি। অবরোধ একাধারে তিন বছর স্থায়ী হয়। পর শেষ পর্যন্ত কুরাইশদের পক্ষ থেকে রাসুল (সঃ) ও তার সঙ্গী-সাথীদের মুক্তির আন্দোলন শুরু হয়। চুক্তি ভঙ্গ করতে কুরাইশদের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা শিহাব ইবনে আমের ও আব্দুল মুত্তালিবের দৌহিত্র যুবায়েরকে সঙ্গে নিয়ে উভয়ে মিলে মোত'আম ইবনুল আদ্দির কাছে গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে আবুল বোখতারী, ইবনে হিশাম এবং যুম'আ ইবনুল আসওয়াদ এ চুক্তি ভঙ্গ ও তাদের মুক্তি আন্দোলনে সমর্থন দান করে সার্বিক সযযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে শিয়াবে আবু তালিব থেকে বন্দীদের মুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। পরদিন সবাই মিলে পবিত্র হেরেম শরীফে উপস্থিত হয়ে সেখানে যুবায়ের সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে সম্বোধন করে বলেনঃ 

‘‘হে মক্কাবাসীগণ! এটা কেমন কথা যে, আমরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করবো। ভালো ভালো খাবার খাব। আর বন্দী বনি হাশেমদের ভাগ্যে সামান্য খাবারও জুটবে না? বন্দী বেশে তারা মানবেতর জীবন যাপন করবে; তা হয় না। খোদার কসম! বন্দীর পূর্বে যে অন্যায় বন্দী চুক্তি হয়;  সে চুক্তিপত্র ছিড়ে না ফেলা পর্যন্ত আমি শান্ত হব না।’’ 

অতঃপর বনী হাশেমের সাথে আত্মীয়তা আছে এমন কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি জনসমাবেশে চুক্তি ভঙ্গ করার কথা ঘোষনা করেন। চুক্তির কাগজ বের করা হলে দেখা যায় যে সেটা কোনো পোকা খেয়ে ফেলেছে । শুধু কাগজের এক কোণ যেখানে “বিসমিকা আল্লাহুম্মা” লেখাছিল সেটাই অক্ষত রয়েছে। ফলে কাগজটি ছিড়ে ফেলা হয়। জনতা ও কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সামনে আবু জাহেলকে পদদলিত করে মোতআম ইবনে আদ্দি, ইবনে কায়েস, যুম'আ ইবনুল আসওয়াদ ও আবুল বোখতারী প্রমুখ মিলে সশস্ত্র হয়ে যোবায়েরের নেতৃত্বে উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে সে মূহুর্তেই শিয়াবে আবু তালিব দূর্গে গমন করে বন্দীদের মুক্ত করে নিয়ে আসলেন। ফলে রাসুল (সঃ) ও তার সঙ্গী-সাথী শিয়াবে আবু তালিবের অন্তরীণ জীবন থেকে ফিরে আসেন নির্মল আলোর মুক্ত সমাজে। 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিবিধ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


মক্কার পবিত্র কাবার ঘরের সংলগ্ন উত্তরের কিছু অংশ অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্ত...

বিবিধ | 2018-08-14 23:29:33

আমরা কোনো কঠিন মূহুর্ত বা বিপদের সম্মুখীন হলে খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ি। আল...

বিবিধ | 2021-06-24 04:03:23

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, উভয় ধর্মেই পৃথিবীর সমাপ্তির পর্বের মিথ্যা খোদা দা...

বিবিধ | 2021-09-05 19:36:28

গত ১৪ই জুন ক্রীড়াজগতের অন্যতম বৃহত্তম আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের আনুষ্ঠানিক...

বিবিধ | 2018-06-22 22:32:19

রাত ১২টা বা ১টা পর্যন্ত জেগে থাকাটা ছিল আমার অন্যতম একটি বদভ্যাস। ছোট...

বিবিধ | 2018-03-26 09:49:08

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, উভয় ধর্মেই পৃথিবীর সমাপ্তির পর্বের মিথ্যা খোদা দা...

বিবিধ | 2019-02-17 23:09:17

ইবনে খালদুন আসাবিয়াতত্ত্ব বা গোষ্ঠী সংহতির উপর রাষ্ট্র দর্শনের ভিত্তিক...

বিবিধ | 2019-03-29 23:50:18

১. ধৈর্যশীল যিনি সব পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণে সক্ষম, কখনোই চিৎকার চেঁচাম...

বিবিধ | 2021-09-04 20:19:56