সাহিত্য সাধক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ


ড. মঞ্জিলা শরীফ
Published: 2023-12-28 06:45:25 BdST | Updated: 2024-05-05 17:06:55 BdST

খুব ছোট্ট একটি শব্দ সেবা। দুই অক্ষরের ছোট্ট শব্দ হলেও এর ব্যপকতা অনেক। সেবা করাটা কিন্ত অতো সহজ নয়। সাধনা করতে হয় অনেক। এখানে সফলতা পেতে হলে এর সাথে একনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে হয়; যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা বিভিন্নজন বিভিন্ন কাজকে সেবা হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে সাধনা করি। কেউ সফল সেবক বা সাধক হয়ে উঠতে পারছি কেউবা পারছিনা। শুরুতেই বা মাঝামাঝি এসে মুখ থুবরে পড়ে যাই। এই বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে দীর্ঘ সময় সাধনা করতে হয়। তবেই না লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব। আর যে পেরেছে সেইতো প্রকৃত বা সফল সাধক। আজ আমি এমনই একজন সাধকের কথা বলছি, যিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন ছোটকাল থেকে। যার হৃদয় বাগানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা নাচানাচি করে। সাহিতের সোনালী পালকে আগা গোড়া আবৃত ও সাহিত্যের সকল শাখায় যার অবাধ বিচরণ। সাহিত্যই যার নেশা ও পেশা। মতিহারের সবুজ চত্বর তাঁর অবাধ পদচারণায় সতেজ ঘাসের গালিচা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের প্রিয় চেনামুখ নন্দিত প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ।

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ সেই কৈশোর থেকে সাহিত্য সাধনা করে আসছেন। কৈশোরের কিশোর মাহফুজ বা মাফুজার নামে যাকে ডাকা হতো সেই রাখাল বালক মাফুজার পালবাঁধা ছাগলের হেঁটেচলা পায়ের খুঁড়ের তালে উড়ে যাওয়া ধূলোয় সাহিত্যের তাল ছন্দ কবিতার তান দেখতে পেতেন। সেই ছোট্ট হৃদয়ে সাহিত্য দোল দিয়ে যেতো সেই ছন্দে। তখন সেই কচি হৃদয় বুঝতে পারতো উড়ে যাওয়া ধূলোর পরতে পরতে ছন্দের ঢেউ। তাইতো গহীন বুকের উঠোন ভেদ করে দু'ঠোঁটের কোল বেয়ে বেড়িয়ে আসতো রাখালি গান। মনের অজান্তে ফসলি জমির আইল, দুরন্ত মেঠো পথে দূর্বাঘাসে পা ফেলে ফেলে গান গেয়ে ফিরতেন মায়ের কোলে। সকাল থেকে সাঁঝ অবধি স্কুল উদাসী বালক রাখালীয়া অনুভবে ঘুরে বেড়াতেন সবুজ বন ফসলি মাঠ আর কালপানি নদীর একূল ওকূল ধরে। বালক মাহফুজার স্কুল উদাসী হলেও তার কোমল মনের পুরাটাতেই ছিল সাহিত্যের বসবাস। তাকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধেছিল সাহিত্য। তাই তো মনের অজান্তেই একদিন কালপানি নদীর বুকে ভেসে যাওয়া ধনচে ফুল দেখে রচনা করলেন 'ধনচে ফুলের নাও' নামক কবিতা। সেই নামে একসময় প্রকাশিত হলো একটা কাব্যগ্রন্থ। একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধনা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

শৈশব আর কৈশোর কাল থেকেই আখন্দের মনের ভিতরে উথাল পাথাল করা সাহিত্য একসময় বিরাট সাহিত্য ভান্ডারে রুপ নিয়েছে। একজন সাহিত্য সাধক হিসেবে ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ সফল ও সার্থক। সাহিত্যের সকল অঙ্গনে তাঁর অবাধ ও সফলতাময় বিচরণ। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার, তিনি বিশিষ্ট গবেষক এবং সাহিত্য সমালোচকও বটে। তার সঙ্গীত ও কাব্য রচনার সৌষম্য ও নন্দনবোধকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। কারণ বিশ্বাসের আলেতে তাঁর চিন্তা পরিশ্রুত।
জীবনবোধের ইতিবাচক নৈতিকতা বিশ্বাসবোধের ঔজ্বল্য এবং নান্দনিক জীবন চৈতন্যের প্রগাঢ়তা তার গান কবিতা ও অন্যান্য লেখার শরিরে নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে।

ড. আখন্দের 'হৃদয় বাঁশির সুর' কাব্যগীতিতে ' হামদ' কবিতা এবং গানে প্রভূর সৃষ্টিসত্তার প্রশংসা করেছেন। তাঁর গানসমূহের গঠন ও শব্দশৈলীর মধ্যে একটি শুদ্ধতা ও সুন্দরতা অকপটে বিরাজ করে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসাকীর্তন করে রচিত নাতে রাসুল এ তিনি বলেছেন

সকল শিশুর বন্ধু তিনি
গরীব দুখির সাথী
দুজাহানের নেতা তিনি
আঁধার ধরায় বাতি।।

সদাহাস্য সদালাপি রসিকপ্রিয় কল্পনা আর বাস্তবে ড. আখন্দের গলাগলি। প্রেমের অন্ধবাতাস রোমাঞ্চ পাগল ছড়াকারের হৃদপিন্ড প্রেমের দোলনায় দোল খেলে যায়। তাঁর একবাক্সো প্রেমের অনুকাব্য 'তোমার চোখে হরিণমায়া' ছড়াগুচ্ছ পড়লেই তা স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। ছোট ছোট বাক্যে বাস্তবতায় অনন্য সৃষ্টি কবিতাগুলো। সেখানে প্রেমের আকুতি আছে, আছে উর্বশীর প্রেমের আগুনে হৃদয় পোড়ায় কিন্তু ধরা দেয় না। অনেক সাধনায় যখন প্রেম হয়ে যায় সে প্রেমে অবশেষে বিচ্ছেদ; এমন প্রেমের এ রোমান্টিক রূপ ছন্দে ছন্দে ফুটিয়ে তুলেছেন রসিক কবি তার অনুকাব্যে_

তোমার চোখে হরিণ মায়া
ঠোঁটে বাঁকা চাঁদ,
রাখবো তোমায় বুকের ছায়ায়
তাই পেতেছি ফাঁদ।

হৃদয় হরণকারীর হেঁটে যাওয়া রুপ দেখে ভাবুক কবির মন পূর্ণিমার চাঁদ মনে করে বলেই দিলেন_
'হায়রে
জোসনা মাখা পূর্ণিমা কে যায় রে!

প্রেম পিয়াসী হৃদয়ে দোলা দেওয়া ষোড়শীকে কিভাবে বলবে তাকে ভালোবাসে শেষ মেশ চিরাচরিত নিয়ম কাজে লাগালো কবি_
'তোমার ঠোঁটে শিউলী ফুলের হাসি
সেই মায়াতে রাখাল আমি
তুমি সুরের বাঁশি।'

অথবা
'প্রেম তিয়াসে বোশেখ দুপুর
তোমায় পেতে কাতরাই
দাওনা মনের দুয়ার খুলে
প্রেম দরিয়ায় সাঁতরাই।'

অথবা
'প্রেম বাগানে তুমি গোলাপ ফুল
সেই বাগানের মালি হওয়া
কাঁটার আঘাত কষ্ট সওয়া
সব'চে বড় ভুল।
কারণ
খুলে বলা বারণ।'

এভাবেই কবি নারীর মনের এপিঠ ওপিঠের খবর বুঝার অনেক চেষ্টা করে শেষ মেশ এটাই ধরে নিয়েছেন যে নারীর মন কচুপাতার পানির মত। তা বুঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো নেই। ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দের অনবদ্য প্রেমের গুচ্ছ ছড়াগুলোতে তাঁর একনিষ্ঠ সাধনার সফল প্রকাশ মেলে।

ড. আখন্দ শুধুই যে প্রেম পিরিতি নিয়ে মানব মনের বিকিকিনি করেছেন তা নয়। তিনি শিশু কিশোদের জন্য শিশুতোষ সাহিত্য রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। 'জ্বীনের বাড়ি ভূতের হাড়ি' তাঁর শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ। একই গল্পেই বইয়ের শুরু ও শেষ। নৈতিক মূল্যবোধ তৈরীসহ গল্পটি শিশুমনের চাহিদা পুরণে সক্ষম হয়েছে। তাঁর শিশুতোষ রচনায় ভৌতিক, জাগতিক, রম্য কিংবা আদর্শিক মূল্যবোধ ফুটে উঠেছে। ভৌতিক বিবরণে সাহস জোগানোর জন্য তিনি বলেছেন----
'ধুত্তুরি ছাই, শোননা বলি ভয়টা কিসের!
আগুন রঙের কোদাল দাঁতে
ভূতটা হাঁটে মধ্যরাতে
থাকলে পাশে শুনবি হাসি
সরাৎ কিংবা পাতার বাঁশি
কিংবা পাবি শব্দ দোয়েল শিসের
চোখ কপালে নেইকো চোখের ভুরু
গল্প শুনে বুকটা দুরু দুরু।'
এরকম অনেক কাল্পনিক রূপকথা শিশুমনে দোলা দিয়েছে। এটি তাঁর একান্ত সাধনার ফসল।

কবি, সুসাহিত্যিক, গীতিকার সুরকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং শুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্লান্তহীন প্রাণপুরুষ ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশুদ্ধধারার সাহিত্য চর্চার ময়দান তৈরীর। যেখানে অগণিত সাহিত্য প্রেমীর আনাগোনা বা তাদের পদচারণায় মুখরিত থাকবে সাহিত্যাঙ্গন। তিনি নিজেকে একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধকরূপে প্রকাশ করেছেন।

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ শুধু গান, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধেই স্বাক্ষর রাখেননি তাঁর 'রোহিঙ্গা সমস্য ও বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণায় রোহিঙ্গা সমস্যার প্রকৃত ইতিহাস তুলে এনেছেন। তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের অধিবাসী। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর যাবত আরাকান মোটামুটি একটি স্বাধীনরাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।
জাফর কাওয়াল নামে আকিয়াবের জনৈক যুবক রোহিঙ্গা মুক্তি আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি কাওয়ালী গাইতেন বলে তাঁকে কাওয়াল বলা হয়।
ড. আখন্দ তাঁর গবেষণায় রোহিঙ্গা ও আরাকানের সঠিক ইতিহাস চিত্রিত হয়েছে।
সাহিত্যসাধনা এবং গবেষণাকে সমান্তরালে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই দূরহ সৃষ্টিকর্মই তাঁর সাধনার ইতিবৃত্ত বলে দেয়। সত্যিই তিনি একজন সফল সাধক।

পেশাগত জীবনে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ১৯৭২ সালের ২৮ ডিসেম্বর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার মুক্তি নগর ইউনিয়নে শ্যামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বলিষ্ঠ এই সাহিত্য সাধকের সুস্বাস্হ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

(লেখকঃ কবি ও গবেষক; জেলা পাবলিক হেল্থ নার্স, সিভিল সার্জন অফিস রাজশাহী।)

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ, মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোর...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-05-18 16:38:37

ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে আমার জানাশোনা খুবই কম। আমি যেসব ক্যালিগ্রাফি করে...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-03-11 22:23:04

মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2017-10-28 15:34:39

হে আল্লাহ হে সমস্ত উদয়দিগন্ত ও অস্তাচলগামী আলোকরশ্মির মালিক আজকের এই প...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-06-13 02:59:21

সে নয় ঘরের কেউ, তবু ঘরেই ঘুমন্ত। অতিশয় শীর্ণ অবয়ব, এলোমেলো দীর্ঘ চুল,...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-06-10 02:26:13

যখন মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গন করবে যখন নিয়ে যাওয়া হবে আমার কফিনতুমি কখনোই এ...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-12-17 07:21:56

বইটি লেখার কাজ শুরু করা ২০১৬ সালের জুন মাসে। বই লেখার জন্য প্রথম যখন ত...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-02-26 00:27:10

বইটি যখন প্রথম পড়া শুরু করি, তখনও জানতামনা কতখানি চমক অপেক্ষা করছে। তা...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2017-11-16 15:02:20