রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি অবহেলা মানবতার প্রতি অবজ্ঞা : এপিএইচআর


ইসলামী বার্তা ডেস্ক
Published: 2022-12-23 22:23:11 BdST | Updated: 2024-09-28 09:17:53 BdST

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও রোহিঙ্গা সমস্যার যথার্থ কোন সমাধান হয়নি।

তারা যেমন বাংলাদেশে সঙ্কীর্ণ শরণার্থী শিবিরে চরম কষ্টে জীবন যাপন করছে, অন্যদিকে এখনও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিয়ানমার থেকে তারা ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করছে।  

উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দমন অভিযানের পর ৭ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন যে, ভয়াবহ গণহত্যা এবং ধর্ষণ এ অভিযানের অন্তর্ভূক্ত ছিল। শুধুমাত্র মুসলিম হবার অপরাধে তাদের উপর এমন অত্যাচার করা হয়।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এই মাসের শুরুর দিকে রিপোর্ট করেছে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় ভ্রমণের বিষয়টি "নাটকীয়ভাবে” বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছেনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে  ও শরণার্থী শিবিরে পরিস্থিতি অবনতিকে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। 

গত ২ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে আন্দামান সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাকারী মানুষের সংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধির কারণে একটি সতর্কতা জারি করে। জাতিসংঘের মতে, আনুমানিক ১৯২৯ জন রোহিঙ্গা এই বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে সমুদ্রপথে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ ছেড়েছে, যেখানে ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৮৭ জন। আর এ সংখ্যাটি ২০২০ সালে চেয়ে ছয় গুণ বেশি। 

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এসব মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ যাত্রায় প্রায় ১১৯ জনের মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা সংবাদ হিসাবে বেশ আলোচিত হয়েছে।

 

দুই সপ্তাহ ধরে সাগরে অভুক্ত: প্রায় বিশ জনের মৃত্যু

গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, দ্য কুইন্ট দ্বারা প্রাপ্ত ৯০-সেকেন্ডের একটি ফোন কলে দেখা যাচ্ছে নারী ও শিশুসহ প্রায় ২০০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী একটি নৌকা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় জলসীমায় আটকা পড়েছে। সমুদ্রে আটকা পড়া নৌকার ক্যাপ্টেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করা শরণার্থী মোহাম্মদ খান রেজুয়ানকে রবিবার ফোনে বলছিলেন, “আমরা এখানে মারা যাচ্ছি। সামুদ্রিক স্রোত আমাদের মালাক্কা প্রণালী থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে।” রেজুয়ান খানের বোন তার পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে নৌকায় রয়েছে। জিপিএস অনুসারে নৌকাটি তখন ভারতীয় জলসীমায় ছিল, নিকোবরের ক্যাম্পবেল উপসাগর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে।

কক্সবাজার জেলায় বসবাসকারী উক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ রেজুয়ান টেলিফোনে আল জাজিরাকে বলেন যে, নৌকায় আটকা পড়া লোকদের মধ্যে তার বিধবা বোন ফাতিম উন নিসা (২৭) এবং তার পাঁচ বছরের মেয়ে উমি সালিমা রয়েছেন। নৌকায় থাকা অন্তত তিনজন ইতিমধ্যেই অনাহার এবং পানিশূন্যতার কারণে মারা গেছে। তারা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানি, খাবার ছাড়া সমুদ্রে প্রায় চলাচল অযোগ্য নৌকায় ভাসছে। তার বোন ২৫ নভেম্বর কক্সবাজারে ক্যাম্প ত্যাগ করেছে। এ যাবত সে দুই মেয়েকে নিয়ে ক্যাম্পে একা লড়াই করছিল, এখন এক মেয়ে তাদের সাথে আছে। 

মোহাম্মদ রেজুয়ানের ভাষ্যমতে মৃতের সংখ্যা তিনজন হলেও এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে রিপোর্টে প্রকাশ। বিগত ২১ ডিসেম্বর আল জাজিরা আত্মীয় ও উদ্ধার কর্মীদের বরাতে জানায় যে, ১৬-২০ জনের মত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা গেছে বা কেউ ডুবে গেছে। “আমরা অনুমান করছি যে সম্ভবত ২০ জনের মতো মারা গেছে, কিছু সংখ্যক ক্ষুধা ও তৃষ্ণায়, এবং অন্যরা হতাশায় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা গেছে। এটা একেবারেই ভয়ঙ্কর এবং আপত্তিকর,” বলেন আরাকান প্রকল্পের পরিচালক ক্রিস লেওয়া যেটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সাহায্যে কাজ করে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ডিসেম্বরের শুরুতে নৌকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছিল এবং তারা একটি জরুরি অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানের আহ্বান জানায় তখন।

গত মঙ্গলবার এপিএইচআর [ASEAN Parliamentarians for Human Rights (APHR)], আসিয়ান-এর সদস্য রাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলিকে তাদের মানবিক দায়িত্ব হিসাবে নৌকায় থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধার করার আহ্বান জানায়।

"এটি লজ্জাজনক যে গুরুতর বিপদগ্রস্থ পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের নিয়ে ভেসে থাকা একটি নৌকাকে এভাবে ফেলে রাখা হয়েছে," বলেছেন এপিএইচআর-এর বোর্ড সদস্য ইভা সুন্দরী৷ তিনি বলেন, ‘নৌকায় থাকা মানুষগুলোকে অবহেলা করা মানবতার প্রতি অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু নয়।

এদিকে গত ১৯ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানায়, নৌবাহিনী দেশটির উত্তর উপকূলে ১০৪ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে। নৌবাহিনী বলছে, তারা মিয়ানমার থেকে ইন্দোনেশিয়ায় যাচ্ছিল। পথে সমুদ্রে ইঞ্জিন সমস্যায় পড়ে । নৌকাটি প্রথম শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী সনাক্ত করে যখন এটি উপকূল থেকে ৩.৫ নটিক্যাল মাইল (৬.৫ কিমি) দূরে ছিল। নৌবাহিনীর মুখপাত্র ক্যাপ্টেন গয়ান বিক্রমসুরিয়া বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, “তাদেরকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ তাদেরকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করবে যিনি পরবর্তী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।" বিক্রমসুরিয়া জানান, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৯ জন নারী ও ২৩ জন শিশু রয়েছেন। রয়েছে একজন ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ, একজন মহিলা এবং তার দুই সন্তান। ছোটখাটো অসুস্থতায় ভুগছে বলে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এদিকে ৮ ডিসেম্বর, ভিয়েতনামের একটি তেল পরিষেবা জাহাজের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের উপকূলে ১৫৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী একটি নৌকা উদ্ধার করা হয়। সেসব শরণার্থীদের মিয়ানমারের নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

প্রিয়ালি সুর নয়াদিল্লির একজন অধিকার কর্মী যিনি উদ্বাস্তুদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, শরণার্থীদের জীবন বাঁচাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা উচিত।

অন্যদিকে মঙ্গলবার এপিএইচআর বলেছে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার করতে এবং বাংলাদেশের শিবিরে বসবাসকারী প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের জন্য সামরিক শাসিত মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের উপর চাপ দেওয়া সহ সংকটের মূল কারণটি মোকাবেলা করতে হবে। এপিএইচআর বোর্ডের সদস্য এবং থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরোম্যা বলেছেন, "আসিয়ান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেক দিন ধরে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে কারণ রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি বছরের পর বছর ধরে উন্মোচিত হয়েছে।" "যেসব দেশ মানবাধিকার রক্ষার দাবি করে তাদের রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সংকটের মূল কারণগুলিকে মোকাবেলা করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অথবা এই মানবিক ট্র্যাজেডিগুলি বারবার পুনরাবৃত্তি হবে।"

সবশেষে এপিএইচআর-এর বোর্ড সদস্য ইভা সুন্দরীর সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায় রোহিঙ্গাদের সারা পৃথিবী ও মুসলিম বিশ্বসহ যেভাবে অবহেলা করছে তা মানবতার প্রতি অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সূত্র: আলজাজিরা, ইন্টারনেট

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03