ইসরায়েলে আকস্মিক আক্রমণ: বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার গাজা সম্পর্কে আমাদের যা জানা প্রয়োজন


ইসলামী বার্তা ডেস্ক
Published: 2023-10-08 10:30:56 BdST | Updated: 2024-09-28 09:23:31 BdST

১৯৭৩ সালে মিশর কতৃক ইসরায়েল আক্রমনের পর গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চমকপ্রদ আক্রমন হলো ইসরায়েলে। আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসনের জবাবে এই হামলা হয়েছে।

বিগত ৭ অক্টোবর শনিবার ভোরে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল আক্রমণ করে। হামাসের নেতৃত্বে এই আক্রমণে ইসরায়েলের  নাহাল পদাতিক ব্রিগেডের ইসরায়েলি কমান্ডার কর্নেল ইয়োনাটান স্টেইনবার্গ নিহত হন।

রবিবার বিকেলে পর্যন্ত সর্বশেষ খবরে জানা যায়, অন্তত ৬০০ জন ইসরায়েলি নিহত এবং ২০০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪৪ জন ইসরাইলী সৈন্য রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রাক্তন প্রধান এফ্রেইম হ্যালেভি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন যে ইসরায়েলের উপর ফিলিস্তিনি হামলা "সম্পূর্ণ আশ্চর্যজনক" এবং "আমাদের কোনও ধরণের সতর্কতা ছিল না"। তিনি নিউজ চ্যানেলকে আরও বলেন, "কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না।"

হামাসের সামরিক নেতা মোহাম্মদ দেইফ শনিবার ভোরে বলেছেন যে ইসরায়েলে ৫,০০০ রকেট ছোড়া হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই সংখ্যা ২২০০ হবে বলেছে। ছোড়া রকেটগুলো ইসরায়েলের আশকেলন ও বীরশেবা ছাড়াও তেলআবিব ও জেরুজালেমের মত দূরবর্তী অঞ্চলে পৌঁছেছে বলেছে খবরে প্রকাশ। তুলনার সুবিধার জন্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধের সময় পুরো ৫০ দিনের মধ্যে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলি প্রায় ৪০০০ রকেট নিক্ষেপ করেছিল।

এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা গাজা থেকে ইসরায়েলেও প্রবেশ করে। কতজন ইসরায়েলে প্রবেশ করেছে তা স্পষ্ট নয়, তবে সংখ্যাটি কমপক্ষে কয়েক ডজনের মধ্যে হবে বলে মনে করা হয়। হামাস ইসরায়েলের সীমানা বেড়ার একটি গর্ত দিয়ে মোটরবাইকে ইসরায়েলে যোদ্ধাদের যাওয়ার ফুটেজ প্রকাশ করেছে।

ইসরায়েলি মিডিয়া জানিয়েছে যে প্যারাগ্লাইডিং করে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা বেড়ার উপর দিয়ে উড়ে যায়, তারপর অন্যদের প্রবেশ করার জন্য গেট খুলে দেয়। অনলাইনে প্রচারিত অযাচাইকৃত ফুটেজে প্যারাগ্লাইডারদের ইসরায়েলে প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছে। হামাস পরে প্যারাগ্লাইডিং সরঞ্জাম ব্যবহার করে ঢোকা তার যোদ্ধাদের ফুটেজ প্রকাশ করেছে, তবে এটি শনিবার চিত্রায়িত হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রিচার্ড হেচট নিশ্চিত করেছেন যে এটি একটি "সম্মিলিত গ্রাউন্ড রেইড যা প্যারাগ্লাইডারের মাধ্যমে, সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এবং স্থলপথে হয়েছে"।

রবিবার বিকেলে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা যায়, হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভেতরে তখনও অপারেশন পরিচালনা করছিল।

হামাসের সামরিক শাখার নেতা মোহাম্মদ দেইফ বলেছেন, জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসনের জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। "প্রতিদিন, দখলদার বাহিনী পশ্চিম তীর বরাবর আমাদের গ্রাম ও শহরগুলিতে হানা দেয়," দেইফ বলেন। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহ ধরে উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদি গোষ্ঠীর আহ্বানের পর হাজার হাজার ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী জেরুজালেমের মসজিদ কমপ্লেক্সে উস্কানিমূলক সফর করছে।

এদিকে ইসরাইল এই হামলার জবাবে পাল্টা বিমান হামলা করেছে। তারা ঘোষণা করেছে যে তারা যুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, "আমরা যুদ্ধে রয়েছি, এটা কোনো অপারেশন নয়।" "হামাস ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং এর নাগরিকদের বিরুদ্ধে একটি হত্যামূলক আশ্চর্যজনক আক্রমণ শুরু করেছে৷ প্রথমত, আমি সমস্ত বসতিগুলিকে অনুপ্রবেশকারী সন্ত্রাসীদের থেকে শুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি এবং আমি বড় আকারের মজুদ সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছি৷ শত্রুকে এমন মূল্য দিতে হবে যা সে কখনও জানে না।" ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা বলেছে যে তারা বিদ্যুৎ, জ্বালানি সরবরাহ এবং গাজায় পণ্য স্থানান্তর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৩১৩ জন নিহত এবং প্রায় ২০০০ জন আহত হয়েছে।

এদিকে আরব লিগের প্রধান আহমেদ আবুল গীত "গাজায় সামরিক অভিযান" এবং "দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের চক্র" অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন,"ইসরায়েলের সহিংস ও চরমপন্থী নীতির ক্রমাগত বাস্তবায়ন একটি টাইম বোমা যা এই অঞ্চলকে অদূর ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতার কোনও ঐকান্তিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।"

 

গাজা সম্পর্কে আমাদের যা জানা প্রয়োজন

 

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের আগে গাজা ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের অংশ ছিল। ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইন থেকে ৭,৫০,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বহিষ্কার করা হয়েছিল যা আল-নাকবা বা বিপর্যয় নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন অংশে পরিবারগুলিকে বহিষ্কার করার ফল হিসেবে বর্তমানে গাজার ৬০ শতাংশেরও বেশি অধিবাসী ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু। 

ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে ইসরায়েল এবং মিশর দ্বারা সীমানাযুক্ত গাজা স্ট্রিপ প্রায় ৩৬৫ বর্গ কিমি এলাকা এবং ২.১ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিদের বাসস্থান। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় গাজা মিশর দ্বারা দখল করা হয়েছিল এবং ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ পর্যন্ত মিশরীয় নিয়ন্ত্রণে ছিল। ৬৭ সালে অঞ্চলটি পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের সাথে দখল করে নেয় ইসরায়েল।

২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে নিজেদের তথাকথিতভাবে প্রত্যাহার করে। তারা গাজার চারপাশে ২১টি বসতিতে বসবাসকারী প্রায় ৮০০০ ইহুদি বসতি স্থাপনকারী এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের অধিকৃত পশ্চিম তীরে স্থানান্তরিত করে। কিন্তু ২০০৭ সালে গাজায় নির্বাচনে  হামাসের বিজয়ের পর, ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে অবরোধ আরোপ করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এ ধরনের অবরোধ আসলে দখলের সমতুল্য।

এরপর ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে ইসরায়েল গাজায় চারটি আক্রমণ পরিচালনা করে, যার ফলে বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিক এবং অনেক শিশুসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছে। এসব অভিযানের ফলে বাড়িঘর ও অফিস ধ্বংস, পাইপলাইন এবং পয়ঃনিষ্কাশন পরিকাঠামোর ক্ষতি, পানীয় জলের উপর প্রভাব ফেলে এবং জলবাহিত রোগ বৃদ্ধি পায়। ২০২১ সালে সর্বশেষ বড় অপারেশনে, গাজায় কমপক্ষে ২৬০ ফিলিস্তিনি এবং ১৩ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিল।

 

বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার

ইসরায়েলের অবরোধ পদ্ধতিগতভাবে ফিলিস্তিনিদের সকল নাগরিক পরিষেবা, যেমন হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করে জনগণকে এক অমানবিক, বিপর্যস্ত ও আশঙ্কাময় জীবনযাত্রার মধ্যে রেখেছে। অবরোধের ফলে বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা সরবরাহের চিরস্থায়ী ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যার ফলে গাজাকে প্রায়শই বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গাজার পানীয় জলের প্রায় ৯৭ শতাংশ দূষিত, এবং বারবার ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পাওয়ার গ্রিডের কারণে বাসিন্দারা অবিরাম বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রায় ৬০ শতাংশ ফিলিস্তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং যুব বেকারত্বর হার ৬৩ শতাংশে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দেখাশোনা করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউ (UNRW)-এর মতে, বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাত এবং অবরোধের কারণে গাজায় জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

সূত্র: মিডল ইস্ট আই, আল জাজিরা।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03