ফিলিস্তিনে দ্বিতীয় "নাকবা" বা মহাবিপর্যয় শুরু
আশ সরকার, এস. আব্দুল্লাহ
Published: 2023-10-14 03:25:58 BdST | Updated: 2024-09-28 09:15:37 BdST
ভয়ঙ্কর স্থল আক্রমণের আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী উত্তর গাজার প্রায় ১১ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে ২৪ ঘন্টার সময়সীমার মধ্যে তাদের বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছে। বাড়ি ছাড়লে তাদের ফিরে আসার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই ফিলিস্তিনিরা এটিকে "দ্বিতীয় নাকবা" বা “দ্বিতীয় মহাবিপর্যয়” হিসাবে ঘোষণা করেছে। অবশ্য অনেকে বলছে যে তারা তাদের জমি ছাড়বে না।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে যে এটি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এই নির্দেশকে জাতিসংঘ "বিধ্বংসী মানবিক পরিণতি" ছাড়া "অসম্ভব" বলে নিন্দা করেছে। গাজা শহরের ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের মুখপাত্র নেবাল ফারসাখ অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন যে ইসরায়েলি সময়সীমার আগে এত মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কোনও উপায় নেই। গাজা শহরের হাসপাতালগুলিতে ইতিমধ্যেই জ্বালানী এবং চিকিৎসা সরবরাহ প্রায় নেই। ফারসাখ রিপোর্ট করেন যে অনেক চিকিত্সক হাসপাতাল খালি করতে এবং তাদের রোগীদের একটি অনিশ্চিত ভাগ্যের মুখে ফেলে যেতে অস্বীকার করছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস টুইট করেছেন: "ঘনবসতিপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে এক মিলিয়নেরও বেশি লোককে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেখানে কোনও খাদ্য, পানি বা বাসস্থান নেই - যখন গাজার সমগ্র অঞ্চল অবরোধের মধ্যে রয়েছে - এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং কিছু ক্ষেত্রে, একেবারেই সম্ভব নয়।"
হামাস গাজার উত্তরে ফিলিস্তিনিদের, তারা যেখানে আছে সেখানেই থাকতে বলেছে। উচ্ছেদের আদেশকে "ভুয়া প্রচার" বলে অভিহিত করেছে। শরণার্থী বিষয়ক হামাস কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যে গাজাবাসীদের উচিত "আপন বাড়িতে অবিচল থাকা এবং দখলদারিত্বের দ্বারা পরিচালিত এই জঘন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মোকাবেলা করা"।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ইসরাইল যখন জোর দিয়ে বলছে যে উচ্ছেদের আদেশ সাধারণ গাজাবাসীদের সুরক্ষার জন্য ঠিক তখন গাজা শহরে ইসরায়েলি বিমানের নির্বিচার বোমাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের বলা হয়েছে দক্ষিণে মিশর সীমান্তে রাফাহ ক্রসিং-এর দিকে যেতে, অথচ এই এলাকা বারবার ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হয়েছে। এমন কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যে ইসরাইল একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে যাতে উচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া যায়। বাস্তবতা হল যে জনগণকে নিরাপত্তার কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় যে বেসামরিক নাগরিকরা বাড়ি ছাড়ার পর অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত ফিরতে পারবেনা। ৭৫ বছর আগে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়। ফিলিস্তিনিরা একে মহাবিপর্যয় বা আরবীতে “নাকবা” বলে থাকে। অনেক গাজাবাসী সেসময় বাস্তুচ্যুত হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশোদ্ভূত। এসব পরিবারগুলিকে কখনই তাদের বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হয়নি। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা, তাও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কোনও নিশ্চিত অধিকার ছাড়াই - এটা ১৯৪৮ সালের কুৎসিত ঘটনার প্রতিধ্বনি বহন করে। অকথ্য সহিংসতার হুমকির মাধ্যমে বেসামরিক জনগণের জোরপূর্বক উচ্ছেদকে জাতিগত নির্মূল না বলে কী বলা উচিত?
রিনা আন্দোলিনি নামে তিন সন্তানের জননী এক গাজাবাসী তার বাড়ি ছাড়ার অনুভূতি নিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন: "২০২৩ সালে আজ যখন আমরা নতুন নাকবার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তখন আমার মনে নাকবার সাদা-কালো ছবিগুলো ভেসে বেড়াচ্ছিল - নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে, বিতারিত হতে, আতংকিত হয়ে বিতাড়িত হতে, প্রিয়জনদের পিছনে ফেলে যেতে। গাড়ি ভর্তি ছিল, যারা গাড়ি পায়নি তারা জীবন নিয়ে হাঁটছিল।
সত্যি, ২০২৩ সালে আমরা আর এখানে থাকতে পারব না।
আমার হৃদয় ভেঙে গেছে আমাদের দেশের ধ্বংসের কারণে, আমাদের বাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদের কারণে, যেখানে আমরা আমাদের পরিবারের সাথে স্মৃতি ভাগ করে নিতাম। আমরা কি ফিরতে পারব? এটা কি শেষ হবে? কেউ আর কিছু জানবে না কিন্তু আমরা এর মধ্য দিয়ে যাব।
না। আমি গাজা স্ট্রিপের বাইরে নই। কিন্তু আমি আমার বাড়ি ছেড়েছি এবং আমি আমার পরিবারকে আল্লাহর তত্ত্বাবধানে রেখে যাচ্ছি। আমি আমার পৃথিবীর একটি বড় অংশ ছেড়ে যাচ্ছি।"
গত এক সপ্তাহে কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের অবৈধ সামরিক দখলদারিত্ব এবং বাস্তবে বর্ণবাদ সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলিতে কিছুই বলা হচ্ছে না। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের কোন গুরুত্ব নেই। তারা ২০ লক্ষের বেশি গাজাবাসীর উপর সম্মিলিত শাস্তি আরোপ করেছে। পানি, সাহায্য, খাদ্য, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। তারা ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিশ্চিত করেছে, আইডিএফ গাজা এবং লেবানন উভয় ক্ষেত্রেই সাদা ফসফরাস ব্যবহার করেছে। ইউএন কনভেনশন অন কনভেনশনাল উইপন্সের অধীনে বেসামরিক মানুষের উপর সাদা ফসফরাস ব্যবহার নিষিদ্ধ।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের অমানবিক মনোভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। গাজায় "সম্পূর্ণ অবরোধ" ঘোষণা করার সময়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট নির্লজ্জভাবে বলেন যে "আমরা পশুর সাথে লড়াই করছি এবং আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি"। ইসরায়েলি আইন প্রণেতা ও ক্ষমতাসীন জোটের সিনিয়র একজন, লিমোর সন হার-মেলেচ টুইটারে লিখেন, “গাজায় কোনও নিরপরাধ নেই। (বোমা মেরে) গাজাকে সমতল করে দাও।” নেসেটের সদস্য এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির অংশীদার অ্যারিয়েল ক্যালনার টুইটারে "একটি নাকবা যা ৪৮-এর নাকবাকে ছাপিয়ে যাবে" বলে নতুন নাকবার আহ্বান জানান। গ্যালান্টের গণহত্যামূলক ভাষাটি ইসরায়েলের বিপজ্জনক বাগাড়ম্বরের ঝুলিতে সর্বশেষ সংযোজন।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইসরায়েলি রাজনীতিতে চরমপন্থী মতাদর্শ মূলধারায় এসেছে। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি গ্রাম হাওয়ারাকে "নিশ্চিহ্ন" করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইতমার বেন-গভির, যিনি এখন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী, শেখ জারাহর বাসিন্দাদের দিকে বন্দুক উচিয়ে দেখিয়েছিলেন এবং পাথর নিক্ষেপকারী ফিলিস্তিনিদের উপর লাইভ গোলাবারুদ ব্যবহার করার জন্য পুলিশকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমাহীন টুইটগুলিতে গাজায় আবাসিক টাওয়ার ব্লকগুলিকে ধ্বংস করে ইসরায়েলি বিমান হামলার ভিডিও দেখানো হচ্ছে। এসব এমন একটি ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের ফসল যা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে কেবল মূল্যহীন নয়, বরং অবজ্ঞার বস্তু হিসাবে বিবেচনা করে।
ইতিমধ্যে ছোট্ট গাজা উপত্যকায় ৬ হাজারের বেশি বোমা ফেলা হয়েছে। জাতিসংঘের একজন সাবেক অপরাধ তদন্তকারী মার্ক গ্রলাসকো বলেছেন যে: “ইসরায়েল এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে যতটুকু (বোমা) বর্ষণ করল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তা এক বছরে বর্ষন করেছিল।”
গাজায় ৫ শতাধিক শিশুসহ অন্তত ১৮০০ মানুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিম তীরে ৪৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বুধবার বসতি স্থাপনকারী এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা নিহত চার ফিলিস্তিনির জানাযায় অংশ নেওয়ার সময় ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের গুলিতে নিহত দুই ব্যক্তি। খবরে প্রকাশ, ইসরায়েলি বাহিনী অধিকৃত পশ্চিম তীরে এবং ইসরায়েলে প্রায় ২৬০০ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের জন্য অস্ত্র বিতরণের অনুমোদন দিয়েছে এবং বিতরণ শুরু করেছে।
গাজাতে ইতিমধ্যেই ৪ লক্ষ্য মানুষ গৃহচ্যুত হয়েছে। আবারও দশ লক্ষেরও বেশি গাজাবাসীকে দক্ষিণে পালানোর নির্দেশ দেওয়া হল। কিন্তু কোথাও যাওয়ার জন্য নিরাপদ জায়গা নেই। গাজার দক্ষিণে নেই পর্যাপ্ত বাড়িঘর, পর্যাপ্ত জায়গা বা আশ্রয়। এর একমাত্র বাস্তবসম্মত ফলাফল হল মানুষরা আক্ষরিক অর্থে সিদ্ধ হতে যাচ্ছে; মাথার উপর ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সূর্য - প্রতিদিন, রোদে, রাস্তায়, হাসপাতালের সুবিধা ছাড়া, খাবার বা পানির ব্যাবস্থা ছাড়া, বিদ্যুৎ ছাড়া - ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় নাকবা অভিজ্ঞতার নিছক আতঙ্কের কথা না হয় বাদই দেয়া হল।
গাজার কাছে ৩ লক্ষের বেশি ইসরায়েলি সৈন্য জড়ো করা হয়েছে। সম্ভবত পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। পশ্চিমারা ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধের জন্য তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে চলেছে। একটি গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলের পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন।
অবশ্য মিডল ইস্ট আই-এর প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট এর মতে ইসরায়েল যে নাকবা শুরু করেছে তার উল্টো ফল হবে। কেননা, “গাজা পুনর্দখল করা এবং শুধুমাত্র একটি ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে শেষ করার মাধ্যমে এই অঞ্চলের কৌশলগত বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না।”
সূত্র: নোভারা মিডিয়া, মিডিল ইস্ট আই, ডেমোক্রেসি নাউ, আল জাজিরা।
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: