ফিলিস্তিন সংকট: বিশ্বে গুজবের রাজধানী কোনটি?


মার্ক ওয়েন জোন্স
Published: 2023-10-24 15:56:34 BdST | Updated: 2024-09-28 09:14:41 BdST

একটি বহুল ব্যবহৃত বুলি হচ্ছে, যুদ্ধে প্রথম যা আক্রান্ত হয় তা হলো “সত্য”।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বের মধ্যে ফিলিস্তিন বিরোধীতা এবং ইসলামফোবিয়া থেকে উৎসরিত হচ্ছে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোতে এটা অনেক গুণ বেশি শক্তি লাভ করে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত ইলোন মাস্কের এক্স(X)-এ, যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল।

একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের বেশিরভাগ একাউন্টগুলো ভারত থেকে তৈরি। ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের আক্রমণের পর মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব একাউন্ট থেকে বন্যার পানির মতো ছড়িয়ে পড়ে।  

 এইসব মিথ্যা গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে হামাস একটি ইহুদি বাচ্চাকে অপহরণ করেছে এবং একটি ট্রাকের পেছনে নিয়ে এক যুবকের মস্তক দ্বিখন্ডিত করেছে। নীল চেক দেয়া বিভিন্ন একাউন্ট ভুয়া প্রতিবেদনগুলোকে ভাইরাল স্তরে পৌছে দিয়েছে। হাজার হাজার লোকের দ্বারা শেয়ার হওয়া একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় টুইট এমনকি দাবি করেছে যে, হামাসের হামলাটি ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন মনস্তাত্ত্বিক অভিযান! 

 

 ইসলাম-ফোবিক মিথ্যা-উৎপাদক ইনফ্লুয়েন্সারের উত্থান

ভারতে বিখ্যাত ফ্যাক্ট চেকিং বা সত্যাসত্য যাচাই সার্ভিসগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বুম (BOOM)। বুম দেখিয়েছে বেশকিছু ভেরিফাইড এক্স (X) ব্যবহারকারী মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের শীর্ষে রয়েছে।

বুমের তথ্য অনুসারে এই মিথ্যা ইনফ্লুয়েন্সারগুলো রুটিন মাফিক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করে। এরা ইসরাইলের সমর্থক এবং নেতিবাচকভাবে ফিলিস্তিনিদের টার্গেট করে। তারা মৌলিকভাবে ফিলিস্তিনিদের বর্বর বা নৃশংস দেখানোর চেষ্টা করে। 

 একটি উদাহরণে দেখা যায়, এক্সের একটি একাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রচার করা শুরু হয়। তাতে দাবি করা হয় একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধা কয়েক ডজন তরুণীকে যৌন দাসী বানাতে ধরে নিয়ে গেছে। আসলে ভিডিওটি সম্ভবত ধারন করা হয়েছিল জেরুজালেমের একটি স্কুলে ভ্রমণের সময় । একটু সতর্কভাবে দেখলে দেখা যাবে ভিডিওটির কোয়ালিটি যেমন খুব নিম্নমানের তেমনি মেয়েগুলো হাসি তামাশার সাথে গল্পগুজব করছে এবং ফোন ব্যবহার করছে। 

অথচ এই ভিডিওটি হাজার হাজার রিটুইট হয়েছে এবং অন্তত ৬ মিলিয়ন ইম্প্রেশন (বা ভিউ) পেয়েছে। যেসব একাউন্ট থেকে ভিডিওটি শেয়ার হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের বেশিরভাগই ভারতের। এমনকি এটা টেলিগ্রাম চ্যানেল অ্যাংরি স্যাফরন থেকেও শেয়ার দেয়া হয়েছে। এই চ্যানেলটি ভারত থেকে পরিচালিত একটি উন্মুক্ত গোয়েন্দা সোর্স অথবা OSINT চ্যানেল। এটা দ্বারা বোঝা যায় যে, হয় এটা অগোছালো গোয়েন্দা তথ্য অথবা মিথ্যা-বিভ্রান্তিমুলক তথ্য যার উদ্দেশ্য হচ্ছে OSINT-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা।

 আরেকটি উদাহরণ: একটি ভিডিও ছড়ানো হয়েছে যাতে মিথ্যা দাবি করা হয়েছে যে, হামাস একটি ইহুদি বাচ্চাকে অপহরণ করেছে। এক পোস্টেই ভিডিওটির এক মিলিয়নের বেশি ভিউ হয়েছে। বিভ্রান্তি ছড়ানো সর্বোচ্চ শেয়ার হওয়া ১০টি টুইটের মধ্যে ৭ টির প্রোফাইল ভারতের অথবা তাদের বায়োগ্রাফিতে ভারতের পতাকা রয়েছে। এক্স-এর এই সাতটি টুইট তিন মিলিয়নেরও বেশি ইম্প্রেশন পেয়েছে। অথচ, ভিডিওটি গত সেপ্টেম্বর মাসের - অপহরণ অথবা গাজার সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। 

 

 

ইসলাম-ফোবিয়া, ভারত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

এই ধরনের মিথ্যা ভিডিও শেয়ার করা একাউন্টগুলো এক্স-এ মুসলিম বিদ্বেষী কমেন্ট বা মন্তব্য ছড়াতেও অনেক সময় ব্যয় করে। মিস্টার সিনহা নামের একটি একাউন্ট যিনি শেয়ার করেছেন যে, হামাস একটি ছেলের মস্তক দ্বিখন্ডিত করেছে তিনিই আবার একই পোস্টে হ্যাশট্যাগ দিয়েছেন: #IslamIsTheProblem (অর্থাৎ, ইসলাম হলো সমস্যা)।

 অন্য একটি একাউন্ট যেটি ফিলিস্তিনিরা যৌনদাসী অপহরণ করেছেন মর্মে বিভ্রান্তিকর ভিডিও শেয়ার দিয়েছে, সেটি এর আগে লিখেছে: “একমাত্র পার্থক্য হলো যখন একজন মুসলিম মেয়ে হিন্দুত্ববাদ গ্রহণ করে তখন সে পরবর্তী জীবন খুব সুখে কাটায়। আর যখন হিন্দু মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করে তখন তার জীবন শেষ হয় সুটকেস অথবা ফ্রিজ ভর্তি অবস্থায়।”

অন্যরা ফিলিস্তিনের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়াতে আরও স্পষ্টভাষী। একটি ভারতীয় একাউন্ট যেটার মালিক অবসরপ্রাপ্ত একজন ভারতীয় সেনা, তিনি লিখেছেন, “ইসরাইলকে অবশ্যই বিশ্ব থেকে ফিলিস্তিনকে শেষ করে দিতে হবে।”

 এটা আর গোপন কোন বিষয় নয় যে, ভারতের ইসলাম-ফোবিয়া বা ইসলামভীতির সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী এবং তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পরই এটা বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক ইসলামিক কাউন্সিল অফ ভিক্টোরিয়ার একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় ইসলাম-ফোবিক টুইটগুলোর সিংহভাগই ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ইসলামফোবিক প্রোপাগান্ডাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে, যেমনটি কীট পতঙ্গককে আলোর দিকে টানে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর সাক্ষী। এই অনলাইন বিদ্বেষ বা ঘৃণার একটি অংশ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বিজেপির আইটি সেলে যা ঘৃণার শিখাকে আরও প্রজ্বলিত করছে। 

 স্বাতী চতুর্ভেদী তার ‘আই অ্যাম এ ট্রল’ বইতে বিজেপির অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্মিবৃন্দদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। চতুর্ভেদীর সাক্ষাতকার গ্রহীতাদের একজন হলেন সাধাভী খোসলা। সাধাভী খোসলার তথ্যমতে, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজেপির একটি স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক আছে, যারা বিজেপির সামাজিক মিডিয়া সেল থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করে। এছাড়া রয়েছে সরকার সমালোচক ব্যক্তিদের ট্রল করার জন্য দুটি অনুমোদিত সংস্থা।” খোসলা বলেছেন যে, “ইসলামভীতি, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে ক্লান্ত হয়ে তিনি ‘আইটি সেল’ ত্যাগ করেছেন।” 

 

একটি নিখুঁত ঝড়: মাস্ক, বিজেপি এবং #GazaUnderAttack

 বিজেপির আইটি সেলের ইসলামফোবিয়ার সমস্যা থাকতেই পারে, তবে এর মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর সমস্যাও রয়েছে এবং এই সমস্যা গাজা যুদ্ধের ক্ষেত্রেও প্রকাশিত হয়েছে। 

ভারতের অলাভজনক ফ্যাক্ট চেকিং বা সত্যাসত্য যাচাই ওয়েবসাইট AltNews-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক প্রতীক সিনহা টুইট করেছেন, “ইসরাইলের সমর্থনে ভারত এখন মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর ক্রীড়ানকদের যেভাবে রপ্তানী করছে, তাতে আশাকরি বিশ্ব এখন বুঝতে পারবে যে, ভারতীয় ডানপন্থীরা কিভাবে ভারতকে বিশ্বে গুজবের রাজধানী করে তুলেছে। “ 

ইলোন মাস্ক কর্তৃক এক্স-এর অধিগ্রহণ এবং এই প্লাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টাকে হ্রাস করা সংক্রান্ত তার সিদ্ধান্ত এমন একটি উদাহরণ তৈরি করবে যা ক্ষতিকর কন্টেন্ট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যান্য বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানীগুলোকে প্রভাবিত করবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, মেটা এবং ইউটিউবের মতো কোম্পানিগুলো তাদের প্লাটফর্মে ঘৃণামূলক বক্তব্য, মিথ্যা তথ্য এবং অন্যান্য ক্ষতিকর কন্টেন্ট হ্রাস করার ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতির পূর্ণমূল্যায়ন করবে বলে মনে হয়। 

ইসরাইলের ওপর হামাসের হামলার পর এক্সে মিথ্যা-বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রবাহ তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ার পর গত সপ্তাহে এমনকি ইউরোপিয় ইউনিয়ন মাস্কের কাছে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে।

 ইসরাইলের পশ্চিমা সমর্থন, কন্টেন্টের সংযম বা ভারসাম্যতার ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানীগুলোর উদাসীনতা এবং ভারতের ইসলামফোবিক চরমপন্থী একাউন্টগুলোর ডিজিটাল মাধ্যমে পৌঁছানো গাজা সংকটকে ক্রমান্বয়ে ফিলিস্তিনি এবং মুসলিম বিদ্বেষী লক্ষ্যবস্তুতে রুপান্তর করছে।

সূত্র: আল-জাজিরা

অনুবাদ: আবু সা'দ ও এস. আব্দুল্লাহ।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03