গাজাই একমাত্র স্বাধীন আর বাকি মুসলিম বিশ্ব পরাধীন 


ড. স্পাহিক ওমর
Published: 2023-11-17 23:18:22 BdST | Updated: 2024-09-28 09:17:19 BdST

গাজা ট্র্যাজেডি যতই উন্মোচিত হচ্ছে, ততই এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে এটি শুধুমাত্র খাঁচায় বন্দী গাজা নামক একটি অঞ্চল নয়, এটি একটি  নিয়ন্ত্রিত মুসলিম অঞ্চল এবং গাজার চেয়ে বাকী মুসলিম বিশ্বেরই বেশি সাহায্য ও প্রতিকার প্রয়োজন।

পাশ্চাত্য-ইসরায়েলের অশুভ শক্তির দানবতা যতই বিস্তৃত থাকুক না কেন, গাজা এবং এর বীর জনগণ কখনই তাদের সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ - সম্মান ও মর্যাদা ত্যাগ করবে না। তারা যে ভাবেই যে মানেরই জীবন যাপন করুক না কেন, তা আত্মমর্যাদায় পরিপূর্ণ একটি মানুষের জীবন। তারা তাদের ইসলামী আদর্শের অধিকারী, তারা সেই আদর্শ মেনে চলে এবং প্রয়োজনে তা রক্ষা করতে এবং ইসলামী মূল্যবোধের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তাই, গাজার জনগণ ঠিক তাই করছে, যা ইসলাম আমাদের সকলকে করতে আদেশ করে। গাজা একটি অনুকরণীয় মুসলিম সমাজ, এ হিসাবে তারা পরবর্তী উত্তরসূরিদের জন্য অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত।

প্রত্যেক মানুষের উচিত অগভীর পার্থিব উদ্বেগের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে অস্তিত্বের উচ্চতর স্তরে জীবন যাপন করা। তাদেরকে অবশ্যই বস্তুগত জগতের চাহিদা ও তার অসারতার প্রতি দাসত্বের অবসান ঘটাতে হবে। এর পরিবর্তে মানুষের উচিৎ উচ্চতর পর্যায়ের অর্থবহতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজনে তার মূল্যবান ও সংক্ষিপ্ত জীবনকে উৎসর্গ করা।


গাজার মানুষ গুণী, নীতিবান, সাহসী, অবিচল এবং আত্মমর্যাদাশীল। তাদের মধ্যে সেসব কিছুই আছে যা তথাকথিত সভ্য জগতের সদস্যদের মধ্যে নেই। তারা গোটা পৃথিবীর রত্ন।


মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য, মৃত্যু বরণ করার জন্য বা বিস্মৃতির অতল গহবরে পতিত হবার জন্য নয়। বারবার গাজার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার অপরাধবোধ এবং অপমানের মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে।

গাজার সাথে মুসলিমদের বিশ্বাসঘাতকতা

দুর্ভাগ্যবশত, মুসলিম উম্মাহ এর চেয়ে ভালো কিছু করে না। ঐতিহাসিকভাবে, কেউ ফিলিস্তিন মুসলিমদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়নি। তারা ইহুদিবাদ এবং পশ্চিমা শক্তির কাছে এটি হারিয়েছে। আরো একটি গভীর মূল্যায়ন অনুসারে, মুসলিমরা তাদের সরকার এবং অন্যান্য নেতাদের দ্বারা বিপথগামী হয়ে ফিলিস্তিনকে এভাবে ছেড়ে দিয়েছে।


এখন যেহেতু এটা স্পষ্ট যে মুসলিম জাতি যে ভুল করেছে তার প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ এখনও আছে। গাজার বর্তমান এবং নজিরবিহীন ট্র্যাজেডি মোকাবেলায় মুসলিমরা এখনও পদক্ষেপ নিতে পারে। এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার এবং সম্মানবোধ ফিরে পাওয়ার উপযুক্ত মুহূর্ত। কিন্তু মুসলিমরা এখনও এটাই প্রদর্শন করে চলেছে যে তারা তাদের বোধ শক্তির কোন অগ্রগতি অর্জন করেনি।


সত্যিকারের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তারা এখনও পূর্বের ন্যায় অযোগ্য, কপট এবং অকেজো। তারা কেবলমাত্র পারে কথা বলতে, বিলাপ করতে এবং দোষারোপ করতে। এটা সত্যিই বিব্রতকর কারণ, যখন ভ্রাতৃপ্রতিম গাজা অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি, তখন একজন কাপুরুষ, দুর্বল, পরাজিত এবং যে এই বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেনি এটা তার সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ। তদুপরি এটি এমন মানসিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ যা শিকলবদ্ধ ও সর্বোপরি আধ্যাত্মিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। যা তাকে নির্দেশ করা হয়েছে সে তার বাইরে যাওয়ার সাহস করে না। এই ধরণের ব্যক্তির অপমানজনক কাজের প্রভাব কখোনোই তার মানসিক ও অধ্যাত্মিক শৃংখলের সীমানা অতিক্রম করতে পারেনা।

গাজা স্বাধীন। একারণেই আবারও তারা সম্মানজনকভাবে যা করার তা করছে। আর আমরা বাকিরা যারা চেতনাবিচ্যুত, অসম্মানজনকভাবে শুধু তা করতেই সক্ষম যা করতে একটি মহল আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে কি, সবাই মুসলিম সরকারগুলো থেকে আসা এসব প্রতিক্রিয়ার প্রতি বিরক্ত। এগুলো কোন ফল দেয় না। 

অবাক ব্যাপার! কিভাবে তারা তাদের অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতায় ক্লান্ত হয় না? একটি প্রবাদ রয়েছে এরকম যে, পাগলামী হলো: একই জিনিস বারবার করা কিন্তু ভিন্ন ফলাফল আশা করা। 

কাপুরুষতা (আল-জুবন), উদাসীনতা (আল-কাসাল) এবং দুর্বলতার (আল-জাজ) মত পাপকাজ থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নবী (সা.) দোয়া করতেন। এই দোয়ার গভীর অর্থ বোঝার জন্য যদি কারো প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন হয় তাহলে তার গাজা এবং এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার বাইরে যাবার দরকার নেই।

ইসরায়েলের নিন্দা করাই যথেষ্ট নয়

সকলেই জানে যে নিছক শব্দ তা যত কঠোরই হোক বা কোন প্রকারের নিন্দা ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা সহযোগী গোষ্ঠীর দুবৃত্তপনার কাছে কোন অর্থই বহন করেনা। তারা যে কোন যুক্তিসঙ্গতা ও নৈতিক জবাবদিহিতা থেকে দায়মুক্ত হয়ে গিয়েছে।

তারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে একই ধরনের কাজ করে আসছে। ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের মদদপুষ্ট বেলফোর ঘোষণা জারি করা হয়। এরপরই যেন এক নরকের আবির্ভাব ঘটে। শুরু হয়  ইতিহাস বিকৃতি এবং রক্তপাতের সংস্কৃতি। গাজায় বা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং নিপীড়িত মুসলিমদের মুক্ত করার জন্য আরও বেশি কিছু যে করা প্রয়োজন তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। 

এখন যেহেতু গাজা ইস্যু ভয়াবহতার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, এখন মুসলিম সরকার ও নেতাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের পদক্ষেপ ছাড়া খুবই অল্প কিছু করা সম্ভব। ইসরায়েলের আঘাত অত্যাধুনিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে; তাই এর বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য অবশ্যই একই সমান উপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে। 

মুসলিম জনসাধারণ মানসিকভাবে এবং কিছু পরিমাণে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রমাণ করেছে যে তারা নতুন জাগরনের জন্য প্রস্তুত এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে তারা যেতে চায়। তারা একইভাবে এটাও দেখিয়েছে যে তাদের সাহস এবং চারিত্রিক শক্তি রয়েছে। একটি ঘুমন্ত দৈত্য যেন পুনরুজ্জীবনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মুসলিম সরকারদেরকে বলছি: বল আপনাদের কোর্টে। অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের সময় এখন। আপনাদের আগে যারা ফিলিস্তিন ও উম্মাহর সাথে ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের এবং নিজেদের ভুল সংশোধন করুন।

সময় চলে যাচ্ছে। যদি তা না করেন, তাহলে উত্তেজিত মুসলিম জনতার আবেগ সম্ভবত আপনাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে পারে। 

পাশ্চাত্যের অনুপযুক্ত মূল্যবোধকে বয়কট করুন

আমরা প্রায়ই ভাবি, কী করা যায়। উত্তরটি সোজা: পশ্চিমের দাসত্ব বা বশ্যতার অবসান ঘটিয়ে পচন বন্ধ করুন। 

মুসলিম সরকারগুলোকে বলছি: আপনারা নিজেদের এবং আপনাদের জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করুন। শুধুমাত্র আপনারাই পারেন পর্যাপ্ত সংস্কারবাদী নীতি প্রণয়ন করতে এবং পরিবর্তনের ব্যাপক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, দাসত্বের সমস্ত পথ ও পদ্ধতি বিলুপ্ত করুন। অবশ্যই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক কিছু পদ্ধতি এবং পথ হচ্ছে দেশে এবং বিদেশে পশ্চিমা শিক্ষা, পশ্চিমা মিডিয়া, পশ্চিমা মূল্যবোধ এবং পশ্চিমা পপ সংস্কৃতি।


মুসলিম বিশ্ব ইসলাম বহির্ভূত এই সকল নতুন বিষয় সমূহের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে, যেগুলি লাগামহীন ভোগবাদী, চুড়ান্ত নাস্তিবাদী, এবং অজ্ঞেয়বাদী প্রবণতা দ্বারা পরিপূর্ণ। 


মুসলিম সরকারগুলোর অনেক কিছুই করার আছে, যদি তারা কিছু করতে চান। আমরা সবাই একমত যে সামরিক সংঘর্ষ হচ্ছে সর্বশেষ অবলম্বন। কিন্তু তার আগে যা প্রয়োজন, তা হল মনের মুক্তি, আত্মার পরিশুদ্ধি এবং সেই জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করা যাতে মুসলিম অনুপ্রাণিত পরিচয়, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে স্তম্ভমূলে স্থাপন করা হয়।

সংক্ষেপে কথা হচ্ছে, আপনাদের ছেলে-মেয়েদের বাঁচান। যদি পশ্চিমারা তাদের প্রক্সি ইসরায়েলের মাধ্যমে গাজাকে গ্রাস করতে থাকে, তবে আমাদের বাকি সকলের (মন এবং আত্মার) সাথে একই কাজ করে। তার ধ্বংসাত্মক চিন্তা এবং অনুপযুক্ত মূল্যবোধের মাধ্যমে, যা দিন শেষে আমরা স্বেচ্ছায় আমদানি এবং ব্যবহার করতে থাকি। এগুলো বয়কট করতে কাজ করুন এবং কিছুটা হলেও আপনাদের মুখ বাঁচান।


লেখক : ডঃ স্পাহিক ওমর

ডঃ স্পাহিক ওমর, একজন পুরস্কার বিজয়ী লেখক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া (IIUM) এর Kulliyyah of Islamic Revealed Knowledge and Human Sciences বিষয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বসনিয়া, মিশর এবং মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করেছেন।  ২০০০ সালে, তিনি Islamic history and civilization বিষয়ে কুয়ালালামপুরের মালয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ইসলামী ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সভ্যতা, সেইসাথে ইসলামী নির্মিত পরিবেশের ইতিহাস তত্ত্ব। তাঁর -মেইল: spahico@yahoo.com

অনুবাদ: তারেক হাসান

সূত্র : এবাউট ইসলাম

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03