পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কৃষকদের জমি দখল করছে ইসরায়েলিরা


সিননে ফার্নস বিজার্কেস্ট্র্যান্ড
Published: 2023-11-26 22:04:54 BdST | Updated: 2024-09-28 09:22:29 BdST

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে জলপাই বাগান

ফিলিস্তিনিদের উপর কারফিউ এবং অভিযানের সুযোগে পশ্চিম তীরের অবৈধ ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনী বাসিন্দাদের উপর সহিংসতা এবং সম্পত্তি চুরির হার আগে চেয়ে বাড়িয়ে তুলেছে।

২০২৩ সালের আগস্টে ফিলিস্তিনি কৃষক সালাহ আওয়াদের ফোনে তোলা এই ছবিতে একজন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীকে তার ভেড়ার খামার আক্রমণ করতে দেখা যায়। 

অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কৃষকদের জমি চুরি করছে ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা। অধিকৃত পশ্চিম তীরের কৃষকরা ইসরায়েলি অবৈধ সেটেলারদের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই অনুপ্রবেশ এবং সহিংসতার মুখোমুখি হয়, তারা বলে যে তারা তাদের বাড়িঘর এবং জমি চুরি হওয়ার ভয় নিয়ে থাকে। যে সহিংসতা তারা আশেপাশের শহুরে এলাকায় দেখেছে, যেমন জেনিন শহর এবং শরণার্থী শিবিরের উপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে, মাত্র এক সপ্তাহে ১০ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছে। এই আক্রমন ক্রমশ তাদের গ্রাম এলাকায় যোগ হচ্ছে।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ৭ অক্টোবর থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ২৩৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ২৮৫০ জন আহত হয়েছে।

কৃষক আয়মান আসাদ এবং তার পরিবার শরণার্থী শিবির থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে তাদের বাড়ি থেকে স্পষ্টভাবে আক্রমণ শুনতে পেয়েছে। এভাবে ইসরায়েলিরা গত কয়েক সপ্তাহ আগে তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের পরিবারে জন্য একটি দুঃস্বপ্ন সৃষ্টি করেছে।

আসাদ আল জাজিরাকে বলেন, "শিশুরা ক্রমাগত ভয় পায়। এখন তারা আর বাইরে খেলতে পারে না, ওরা খুব বিপজ্জনক, আমরা শরণার্থী শিবিরে থেকে হামলা, বিস্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।"

আসাদ বলেন, তার ছেলেমেয়েরা আর স্কুলে যেতে পারছে না, কারণ তারা স্কুলে যাওয়ার সাহস করলেও  ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ওই এলাকার অনেক রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। যাতে তাদের সব ক্লাস অনলাইন হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে তার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল তার মুরগির খামার, যা পশ্চিম তীরের এরিয়া সি-তে অবস্থিত। যা ক্যাম্প থেকে আরও দূরে। সেখানে ইসরায়েলি সেটেলাররা আক্রমণ করবে। তিনি এটি রক্ষা করতে অক্ষম। তিনি বলেন, "আমি ভীত যে আমার জমি চুরি হয়ে যাবে।"

ফিলিস্তিন জলপাই, জলপাই তেল এবং শাকসবজির জন্য বিখ্যাত, যা বহুদূরে রপ্তানি হয়। জলপাই গাছ বিশেষ করে ভূমির প্রতি ফিলিস্তিনিদের সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

পশ্চিম তীর ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলে রয়েছে। তখন থেকে প্রায় ৭ লক্ষ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে। বছরের পর বছর ধরে সেখানে ফিলিস্তিনিদের জলপাই গাছ, কৃষিজমি এবং সম্পত্তি চুরি করে যাচ্ছে, কখনো আক্রমণ করছে এবং ধ্বংস করে চলেছে।

রামাল্লার ফিলিস্তিনি কৃষক ইউনিয়ন (PAFU) এর পরিচালক আব্বাস মিলহেম বলেন যে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তাদের এই অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন ইসরায়েলি বাহিনী এবং সেটেলাররা সশস্ত্র অভিযান চালায়, তখন ফিলিস্তিনিরা কারফিউর মধ্যে তাদের বাড়িতে বন্দী থাকে। যাদের জমির প্রতি টার্গেট করা হয়েছে তাদের মধ্যে আব্বাস মিলহেমের নিজের পারিবারিক খামারও ছিল।

পশ্চিম তীরে দ্বিতীয় যুদ্ধ চলছে

মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, পাঁচজন সশস্ত্র ইসরায়েলি সেটেলার মিলহেম খামারে আক্রমণ করে, ফসল কাটাতে কাজ করা লোকদের দিকে বন্দুক ছুড়ে এবং জলপাই চুরি করে। খামারের একজন নারী শ্রমিক ইমান আবদুল্লাহ জাবরি, একটি দলে জলপাই সংগ্রহ করছিলেন যেটিতে তার স্বামীও ছিল।

৪৫ বছর বয়সী ইমান আবদুল্লাহ বলেন, তারা আমাদের দিকে এমনভাবে গুলি চালায় যেন তারা আমাদের ভয় দেখাতে চায়। তারপর তারা কাছে আসে, তারা আমাদের ফোন কেড়ে নেয় যাতে ছবি তোলা সম্ভব না হয়। পরে তারা সমস্ত মহিলাদেরকে চলে যেতে বলে এবং পুরুষদেরকে মারতে শুরু করে, তাদেরকে জলপাই গাছের নীচে মাটিতে বসতে বাধ্য করে। আমরা মহিলারা তখনও দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এর পরে, তারা আমাদের সমস্ত জলপাই নিয়ে যায় এবং আমাদেরকে সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে।

পশ্চিম তীরের বি-এরিয়োতে থাকা সত্ত্বেও খামারটি এখন ইসরায়েলী সামরিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রযুক্তিগতভাবে বেসামরিক বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করে। মিলহেম ও তার কর্মীরা সেখানে আর ফিরে যেতে পারেনি।

ইমান আবদুল্লাহ বলেন, গুলি করলে কৃষকরা আতংকিত হয়। আমার নাতি-নাতনিরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকায় রয়েছে, কিন্তু তারপরও আমাদের যা আছে তার জন্য আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই এবং গাজার জনগণের জন্য প্রার্থনা করি।

আব্বাস মিলহেম বলেন, ফিলিস্তিনে দ্বিতীয় যুদ্ধ চলছে যা অধিকৃত পশ্চিম তীরে সংঘটিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ অধিকৃত পশ্চিম তীরের কৃষকদেরকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।"

তিনি আরো বলেন যে তিনি জেনিনে তার বৃদ্ধ মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারছেন না কারণ ইসরায়েলি বাহিনী অনেক রাস্তা অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

তিনি বলেন, "আমার ছেলেরা যখন রাতে বাহিরে যায় তখন আমিও ভয় পাই, এবং তারা ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য আমি তাদের ক্রমাগত ফোন করি"

সালাহ আওয়াদের খামারে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা পোড়ানো মৌমাছির চাষ

তাদের বন্দুক আছে - আমার শুধু হাত আছে

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী অধিকৃত পশ্চিম তীরে এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ অক্টোবরের মধ্যে আগের চেয়ে অধিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। ২০০৫ সাল থেকে, যখন জাতিসংঘ প্রাণহানির রেকর্ড করা শুরু করেছে তার চেয়ে  এখন বেশি প্রাণহানি ঘটছে। এটি ফিলিস্তিনিদের জীবন-জীবিকার শংকার পাশাপাশি তাদের এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী এবং সশস্ত্র সেটেলাররা ব্যাপকভাবে বর্ধিত অভিযান এবং কারফিউর কারণে ৭ অক্টোবর থেকে কাজ করার জন্য পশ্চিম তীরে চলাফেরা করতে না পারার অর্থ হল সেখানের ফিলিস্তিনিরা একটি বড় সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।

জাতিসংঘের মতে, ৭ অক্টোবর থেকে সেখানে দারিদ্র্যতা বেড়েছে ২০ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদন ৪.২ শতাংশ কমেছে।

রামাল্লার ফিলিস্তিনি কৃষক ইউনিয়ন এর পরিচালক আব্বাস মিলহেম বলেন, রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে এবং ফিলিস্তিনিদের চলাচলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ জলপাই কাটা হয়নি।

ফিলিস্তিনি কৃষক সালাহ আওয়াদ যনি ২৮ আগস্টে অধিকৃত পশ্চিম তীরের দক্ষিণে ওয়াদি তাহতায় তার বাড়ি এবং জমি হারিয়েছেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন যে সেটেলাররা তার জমি আক্রমণ করে, তার সম্পত্তির চারপাশে বেনজিন ঢেলে দেয় এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয়, তার মৌমাছির চাষ ধ্বংস করে। তারা জমি দখল করে নেয় এবং আওয়াদ তার আট সন্তানের পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কয়েকদিন পর তিনি তার একশটি ভেড়া উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু আর জমিতে ফিরতে পারবেন না। ৭ অক্টোবর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে শাব তারিক-এ তার নতুন বাড়িতে অবস্থার অবনতি হয়েছে এবং এখন তার জীবিকা সংকীর্ণতার মধ্যে রয়েছে। তাকে তার জমিতে ভেড়া চরাতে দেওয়া হয় না।

সালাহ আওয়াদ বলেন, "সেটেলাররা আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছে, তারা আমার জমিতে আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে না। আমি ভয় পাচ্ছি যে আমাকে গুলি করা হতে পারে। তারা বন্দুক বহন করে আছে। আমি কি করতে পারি? তাদের অস্ত্র আছে; আমার শুধু হাত আছে।"

আওয়াদ আরো বলেন যে, যুদ্ধ শুরুর আগেও জীবনযাত্রা কঠিন ছিল, কিন্তু দাম এখন তীব্রভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে কৃষকদের জন্য। গত ৭ অক্টোবর থেকে ভেড়ার চারার দাম এক-তৃতীয়াংশের বেশি বেড়েছে।

তিনি বলেন "কেউ আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না, আল্লাহই একমাত্র আমাদের সহায়। ইহুদী সেটেলাররা আমাকে জোর করে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করলেও আমি আর সরব না।" 

অনুবাদ : তারেক হাসান

 সূত্র : আল-জাজিরা

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03