বিশ্লেষণ: ইসরায়েল কি যুদ্ধে গাজা উপত্যকা জয়ের জন্য হামাসকে যথেষ্ট দুর্বল করতে পেরেছে?
জোরান কুসোভাক
Published: 2024-01-07 23:42:05 BdST | Updated: 2024-09-28 09:17:09 BdST
৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর থেকে প্রায় ২৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে যার বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি। নতুন একটি বছর আসার পরও ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক ভাব কোনভাবে প্রশমিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবং এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবে উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
ইসরায়েল শুরু থেকেই বলছে যে তাদের উদ্দেশ্য হামাসের সামরিক এবং শাসন ক্ষমতা দূর করা। এই লক্ষ্যে ৭ অক্টোবর থেকে তারা প্রায় কোন বিরতি ছাড়াই গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ এবং স্থল আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। যদিও ইসরায়েল স্বীকার করছে, তারা এখন পর্যন্ত এই মিশনে ব্যর্থ। তারপরও তারা দাবি করছে যে এই লক্ষ্য অর্জন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু স্থল পরিস্থিতি কি তাদের এই দাবিকে সমর্থন করে? যার উত্তর হচ্ছে না।
এর সাথে সংশ্লিষ্ট দিকসমূহের বিশদ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এই উপসংহারে নিয়ে যায় যে এখনও পর্যন্ত হামাস ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্য বেশি পেয়েছে। তার কারন সমূহ নিম্নরূপ :
হামাস আগের মতই টিকে আছে
সংগঠনটি এখনও বিদ্যমান আছে এবং তার শক্তি দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে এটি এখনও স্বীকৃত। গাজা উপত্যকায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক কাঠামোর অবশিষ্টাংশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগকারী একমাত্র সত্তা হিসাবে হামাসই রয়েছে। এবং হামাসই সেই পক্ষ যা ইতিমধ্যেই গাজায় এক সপ্তাহের যুদ্ধ বিরতি এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বন্দী ও জিম্মিদের সীমিত বিনিময় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যতক্ষণ হামাস অবশিষ্ট জিম্মিদের আটকে রাখবে, ততক্ষণ হামাস একটি "অন্য পক্ষ" হয়ে থাকবে যা ছাড়া সেই বন্দীদের মুক্তি সম্ভব হবে না। ইসরায়েল বারবার বলেছে যে গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী বেসামরিক কাঠামোতে হামাসের জন্য "কোন স্থান নেই" কিন্তু তারা সেখানে কখনো হামাসের বিকল্প শক্ত কোন কাঠামোর পরিকল্পনা বা আভাস দিতে পারেনি।
হামাসকে বাদ দিলে গাজার ভবিষ্যত ভালো হবে- এমন বিভিন্ন অস্পষ্ট, বিক্ষিপ্ত পরামর্শ বিভিন্ন দিক থেকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হামাসকে কীভাবে সরিয়ে দেওয়া যায় এবং তার স্থলে কাদেরকে প্রতিস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে কেউ কোনো সুসংগত পরামর্শ দিতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিছু আরব রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে যে যুদ্ধোত্তর গাজা ফাতাহ বা প্যান-আরব বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত, তবে কীভাবে তা করা যায় তার জন্য কোনও বাস্তব পরিকল্পনা তারা কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি। তাই আপাতত, এই ইচ্ছাপূর্ণ চিন্তা রয়ে গেছে অনুমানযোগ্য ভবিষ্যতের জন্য হামাসই এখানে থাকবে তা বুঝা যাচ্ছে। হামাসের একটি কার্যকর সামরিক বাহিনী বিদ্যমান রয়েছে। হামাসের সামরিক শাখা- কাসাম ব্রিগেড। এর গঠন, সংগঠনিক কাঠামো বা জনশক্তি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত, ওপেন সোর্স তথ্য এবং ইসরায়েল, মার্কিন, আরব এবং রাশিয়ান উত্স থেকে ফাঁস করা গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী অনুমান করা হয় যে কাসাম ব্রিগেডের জনশক্তি ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার যোদ্ধা হতে পারে। এমনকি সবচেয়ে সতর্ক বিশ্লেষকরাও বিশ্বাস করেন যে যুদ্ধের আগেও এই বাহিনীতে কমপক্ষে ১৮ হাজার সুপ্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল এবং আদর্শিকভাবে অত্যন্ত অনুপ্রাণিত প্রথম সারির সৈন্য ছিল। এর বাহিরে দ্বিতীয় স্তরের জনশক্তিও রয়েছে।
অপরদিকে ১০ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করার বিভিন্ন ইসরায়েলি দাবি অবশ্যই অতিরঞ্জিত।
কাসাম ব্রিগেডের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবে এর বেশিরভাগ ব্যাটালিয়ন কার্যকরী যুদ্ধ ইউনিট হিসাবে বিদ্যমান রয়েছে। ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার একটি প্রভাবশালী এবং সুপরিচিত ইউএস থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। যার অনুমান কাসাম ব্রিগেডের ২৬ থেকে ৩০ টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে, যেগুলি ৭ অক্টোবরে বিদ্যমান ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। তার প্রতি ব্যাটালিয়নে ৪০০ থেকে ১ হাজার জন যোদ্ধা রয়েছে। এর মাত্র তিনটি ব্যাটালিয়নকে অকার্যকর বা ধ্বংস করা গেছে। বাকিদের মধ্যে, চার বা পাঁচটি ব্যাটালিয়নের শক্তি হ্রাস পেয়েছে কিন্তু তারা একা বা অন্য ইউনিটে যোগ দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি দিক থেকে হামাসের সামরিক শাখা ব্যতিক্রমীভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।যে সকল ইউনিটের কমান্ডার নিহত হয়েছে সে সকল ইউনিট তাদের ডেপুটিদের অধীনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েল তার চমৎকার ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের উপর নির্ভর করে বিমান হামলায় হামাসের কমপক্ষে পাঁচজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এবং উত্তর ব্রিগেডের কমান্ডার সহ আরও অন্তত ছয়জন যুদ্ধে মারা গেছে। তবুও এই ইউনিটগুলির একটিও "নেতৃত্বহীন" হয়ে যায়নি বা ধ্বসে পড়েনি। যা হামাসের নেত্বত্ব হস্তান্তরের দক্ষ পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের স্পষ্ট ক্ষমতা নিশ্চিত করে।
ইসরায়েল যেখানেই সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ খুঁজে পাচ্ছে সেখানেই সুড়ঙ্গ সমূহ ধ্বংস বা অবরুদ্ধ করে চলছে। তবে এখন স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, যে হামাস এখনও যথেষ্ট ভূগর্ভস্থ সুবিধা বজায় রেখেছে, এবং সৈন্যবাহিনীকে সফলভাবে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে এবং এবং প্রায়শই সফলভাবে শত্রুকে চমকে দিচ্ছে।
হামাস অন্যান্য সশস্ত্র দলগুলো থেকে সহযোগীতা পাচ্ছে
গাজা থেকে পাওয়া খবরগুলো থেকে দেখা যায় যে হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসাম ব্রিগেডই সব যুদ্ধ করছে। আসলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আদর্শিক ব্লকের সাথে যুক্ত সশস্ত্র দল ১২ টির কম হবেনা। দ্বিতীয় সর্বাধিক পরিচিত দল হল ইসলামিক জিহাদ। অন্যদের মধ্যে রয়েছে পপুলার রেজিস্ট্যান্স কমিটি এবং যার প্রায় একই নামে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য দুটি ফ্রন্ট রয়েছে, একটি নিজেকে "পপুলার" বলে পরিচয় দেয় এবং অন্যটি "ডেমোক্রেটিক" হিসাবে। এদের মধ্যে হামাসের সাথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম যে দলটির তা হচ্ছে- আল-আকসা শহীদ ব্রিগেড, এটা হচ্ছে হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ-র সশস্ত্র শাখা। তবুও এই দলটিও রাজনৈতিক মতপার্থক্য বাদ দিয়ে কাসাম ব্রিগেডের সাধারণ কমান্ডের সাথে সমন্বয় করে লড়াই করে।
এই সমস্ত দলকে হামাসের আওয়াত রাখা হচ্ছে মূলত যা প্রয়োজন তার একটি বাস্তবসম্মত সমাধান। এবং এখন পর্যন্ত কোনও দৃশ্যমান উত্তেজনা বা ফাটল ছাড়াই সংশ্লিষ্ট সকলের সন্তুষ্টির জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছে। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর চাপের মধ্যে পড়ে থাকা ছোট ইউনিটগুলিও কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াস, পক্ষ ত্যাগ করা বা শত্রুদের সাথে সহযোগিতা করার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি । তদ্ব্যতীত, এটা ও সম্ভবনা রয়েছে যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্তত সাময়িকভাবে কাসাম ব্রিগেডের সাথে একীভূত হতে পারে। এই সশস্ত্র দল সমূহ একই ধররেন হুমকির সম্মুখীন হওয়ার ফলে তাদের অব্যাহত সহাবস্থান নিঃসন্দেহে হামাসের জন্য সাফল্য।
পশ্চিম তীরে হামাস জনপ্রিয়তা পেয়েছে
৭ অক্টোবরের নির্বিচারে হত্যার খবরের পর হামাসকে অগ্রহণযোগ্য সন্ত্রাসী দল এবং নিরপরাধ বেসামরিকদের হত্যাকারী হিসাবে ইসরায়েলি এবং পশ্চিমা চিত্রায়নের বিপরীতে একটি দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়েছে - অনেক ফিলিস্তিনি একে ভিন্ন ভাবে দেখেন। যারা নিজেদেরকে ইসরায়েলি নিপীড়ন, অসম আচরণ, অনাচার এবং বৈষম্যের শিকার হিসাবে দেখেন তারা প্রায়ই হামাসকে ফিলিস্তিনিদের নির্ভীক রক্ষক হিসাবে একমাত্র দল মনে করে। ১৯৯০-এর দশকের অসলো চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান তৈরি করা। কিন্তু সেই চুক্তিতে যা সম্মত, প্রতিশ্রুতি এবং স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা নিশ্চিত করতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অক্ষমতার কারণে ঐ চুক্তির পর জন্মগ্রহণকারী অনেক তরুণ-তরুণী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের উপর তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করছে। এই হতাশার অনুভূতি বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ফাতাহ দ্বারা পরিচালিত পশ্চিম তীরে। ফাতাহ সরকারকে অনেক তরুণ-তরুণী অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত, অক্ষম এবং ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য কাজ করতে আগ্রহী নয় বলে মনে করে। অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন, যারা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের উপর দায়মুক্তি সহ হয়রানি, চুরি এবং সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সরকারের প্রতি আরো অনাস্থার সৃষ্টি করেছে। পশ্চিম তীরের অনেক ফিলিস্তিনি গাজার যুদ্ধের এই সময়ে প্রায়শই ফাতাহর পতাকার সাথে প্রকাশ্যে হামাসের পতাকা উড়িয়ে তাদের সাথে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। প্রাচীর ঘেরা এবং খণ্ডিত পশ্চিম তীরে বসবাসকারী তরুণ ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘকাল ধরে এই ধরণের আচরন ও নিপীড়ন পেয়ে চরমভাবে ক্ষুব্ধ। অনেকেই এখন তাদের আশা ও প্রত্যাশা তাদের প্রতি ব্যক্ত করছেন, যারা জেগে উঠেছে, লড়াই করেছে এবং ইসরায়েলকে কঠিন আঘাত করেছে, যদিও ইসরাইল অনেক শক্তিশালী। যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তির প্রাবল্য কম এবং বাহিরের লোকজন এতে হতবাক হতে পারে, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে এটি সত্য।
যদিও এটি একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব সম্ভাবনা, তবুও যদি ধরে নেয়া হয়, যদি ইসরায়েল হামাসকে "শেষ" করার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তবুও অনেক ফিলিস্তিনি হামাসকে এমন একটি দল হিসাবে স্মরণ করবে যেটি নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকতে অস্বীকার করেছিল এবং ইসরায়েলের কাছ থেকে আঘাতের পর আঘাত গ্রহণ করে চুপ করে থাকতে অস্বীকার করেছিল। ব্যাপক প্রাণহানি হওয়া সত্ত্বেও এবং পশ্চিমে হামাস যে মন্দ ভাবমূর্তি অর্জন করেছে তা সত্ত্বেও, হামাসের সম্ভবত উদ্বিগ্ন হওয়ার চেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার বেশি কারণ রয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: