ইসলামে শ্রমিকের অধিকার : প্রসঙ্গ মে দিবস


ইসলামী বার্তা ডেক্স
Published: 2024-05-01 22:54:29 BdST | Updated: 2024-05-18 23:26:34 BdST

১৮৯০ সাল থেকে কাজের সময় ৮ ঘন্টা, ন্যায্য মজুরি সহ শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতি বছর ১ মে শ্রমিক দিবস বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়ে আসছে। কিন্তু তার বহু আগেই রাসুল্লাল্লাহ (সা.) শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করেছেন কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে। ১লা মে শ্রমিক দিবস সহ শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন প্রকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন তৈরী করা সত্ত্বেও শ্রমিক দূর্দশা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমরা অত্র নিবন্ধে আলোচনা করবো শ্রমিকদের অধিকারের জন্য আমাদের কোন পথে যাওয়া উচিত।   

শ্রমিক দিবস যেভাবে শুরু হয়

১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মদান করেছিল। তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দুনিয়ার প্রতিটি দেশে পহেলা মে তারিখে নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হয়। কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কাজের উন্নত পরিবেশ তৈরিসহ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে হে মার্কেটের শিল্প শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দিল তিন লাখ শ্রমিক ধর্মঘটে যোগ দিলে সব কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শিকাগোর হে মার্কেটের বিশাল শ্রমিক সমাবেশে মালিকপক্ষ ও পুলিশ হামলা চালালে ১১ জন শ্রমিক মারা যায়। তারপর শ্রমিক আন্দোলন আরো বৃদ্ধি পায়। ১৮৮৯ সালে ২০ দেশের সমাজকর্মী, শ্রমিক নেতা ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে পহেলা মে তারিখ 'মে দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

শ্রমিক দিবস পালনের প্রকৃত ফল কি?

প্রতিবছর বিশ্বের দেশে দেশে মে দিবস পালিত হচ্ছে। শ্রমিক দিবসে নানা আয়োজনে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তার পরও শ্রমের মূল্য, শ্রমিকের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আজও ছিনিমিনি খেলে মালিকরা। নিশ্চিত হয়নি শ্রমিকের বেঁচে থাকার অধিকার। মালিকরা শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এখনো পিছিয়ে আছে। ফলে আজও শ্রমিক লাঞ্ছনার ঘটনা অহরহ ঘটছে। ফলে প্রায়ই শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। এখনো শ্রমের প্রকৃত মূল্যের জন্য শ্রমিকদের রাস্তায়, কারখানায় বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। শিশু শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃত না হলে বাসা বাসাবাড়িতে কাজের বুয়া, কাজের ছেলে জুলুম-অবিচার, দুর্ব্যবহার ও মানসম্মান নষ্ট করা, তাদের প্রাপ্য বুঝে দিতে টালবাহানা করা, তাদের কষ্ট দেওয়া ও নিম্নমানের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান প্রদান করাও জুলুম। সর্বোপরি কোনো ধরনের ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হলে বা কোনো জিনিসের ক্ষতি হলে বা কোনো প্রকারের সময় ক্ষেপণ হলে তাদের প্রতি শারীরিক অত্যাচার, নিপীড়ন করা, গালমন্দ করা করা যা মানবতা বিরোধী ও  রাষ্ট্রীয় আইনের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।

সমাধান কোন পথে

প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থ সমুন্নত করে গেছেন। আল্লাহর নবী (সা.) শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। নবীজি (সা.) প্রণীত নীতি ও আদর্শ আজও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অনন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের আলোকে মহানবী (সা.) যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছিলেন তা শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে প্রকৃত মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক ন্যায়নীতি ও সমতার মাপকাঠিতে নির্ধারণ করেছে ইসলাম। ইসলামে শ্রমের শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করলেও মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান।

কোরআন সুন্নাহর আলোকে শ্রম, শ্রমনীতি ও শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক 

মহান আল্লাহ তায়ালা মালিক ও শ্রমিক উভয়কে আয়-রোজগারের খোঁজে বেরিয়ে যেতে বলেছেন। যেমন বলা হয়েছে- অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে জীবিকার্জনের জন্য তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো (সুরা জুমা-১০)। তিনি আরো বলেন,  নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর রূপে সৃষ্টি করেছি (সুরা বালাদ-৪)। পবিত্র কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রমিক হিসেবে সে-ই উত্তম, যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত (সুরা কাসাস-২৬)।

ইসলামী শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই, যে ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন খাবারের নির্দেশ দিয়েছে। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে বহু নবী-রসুল এমনকি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সবাই শ্রমজীবী ছিলেন। প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) নিজ হাতে চাষাবাদ করেছেন। হজরত লূত ও শিস (আ.) কৃষিকাজ করতেন। হজরত শোয়াইব ও হারুন (আ.) পশুপালন করতেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.) ছিলেন রাজমিস্ত্রি। হজরত ইয়াকুব ও হজরত মুসা (আ.) ছিলেন মেষপালক।

তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে খায়। সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে, তাকে সামর্ধের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না, যদি এমনটা করতে হয় তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে (বুখারি)।

মহানবী (সা.) বলেন, যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি)। তিনি অন্য এক হাদিসে বলেছেন, তোমরা যা খাবে তা থেকে তাদের (শ্রমিককে) খাওয়াবে এবং যা পরিধান করবে তা তাকে পরিধান করতে দেবে। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

শ্রমিকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়ে নবীজি (সা.) বলেন, তোমরা অধীনস্তদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদের কোনো রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জানো না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করো না। (সহিহ বুখারি) শ্রমিকরাও মানুষ। তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও মানবিক অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেন, মজুরদের সাধ্যের অতীত কোনো কাজ করতে তাদের বাধ্য করবে না। অগত্যা যদি তা করাতে হয় তবে নিজে সাহায্য করো। (সহিহ বুখারি) তিনি বলেন, শ্রমিককে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাকে সেটির দুঃসাধ্যতার কারণে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে। (সহিহ বুখারি)। মহানবী (সা.) শ্রমিকের ওপর নির্যাতন করার পরিণাম সম্পর্কে বলেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে স্বীয় দাস-দাসীকে (শ্রমিককে) প্রহার করবে কিয়ামতের দিন তাকে তার পরিণাম দেওয়া হবে। (বায়হাকি) শ্রমিকের মজুরি যথাসময়ে পরিশোধ করার প্রতি মহানবী (সা.) গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, মজুরকে তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি পরিশোধ করে দাও। (ইবনে মাজাহ)

রাসূল সা: বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন হালাল রোজগার করার জন্য। এমনকি প্রত্যেকের জন্য হালাল উপার্জন করা ফরজও। হাদিস শরিফে রাসূল (সা.) বলেন, হালাল জীবিকা সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজগুলোর পরে বিশেষ একটি ফরজ। (শুআবুল ইমান, বায়হাকি, কানযুল উম্মাল-৯২০৩)

হালাল কর্ম যতই ছোট হোক না কেন, তাকে তুচ্ছ করা ঠিক না। যুগে যুগে প্রত্যেক নবীই কোনো না কোনো কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। আর হাদিসে নিজ হাতের উপার্জনের খাদ্যকে উত্তম খাদ্য বলা হয়েছে। হজরত মিকদাদ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, এর চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই, যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জনের মাধ্যমে ক্রয় করে। নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। (বুখারি-২০২৭) হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককে সে দায়িত্ব সম্পর্কে জবাব দিতে হবে। (বুখারি-৭১৩৮)

শিশু শ্রম প্রসঙ্গে

শুধু শ্রমিকের শ্রমঘন্টা ৮ ঘন্টা হলেই বা শিশু শ্রম বন্ধ হলেই শ্রমিকের অধিকার আদায় হয়না। শিশুশ্রম বন্ধ মানে হচ্ছে সকল শিশুর অন্ন বস্ত্র সহ মৌলিক সব চাহিদার যোগান কাউকে দিতে হবে। তাহলে যে সব শিশুর মৌলিক চাহিদার যোগান দেওয়ার কেউ নেই, যারা পিতা মাতাহীন অনাথ তাদের দায়িত্ব সমাজকে নিতে হবে। তারপরই শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করলে তা সঠিক পদক্ষেপ হবে।

শেষ কথা

মে দিবসের শত শত বছর আগে রাসূল (সা.) শ্রমিকদের জন্য এবং শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রকদের জন্য যেসব আইন কানুন ও পদ্ধতি দিয়ে গেছে তাই হচ্ছে শ্রমিকের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ অধিকার। সুতরাং আসুন আমরা শ্রমিক মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং মানব জীবনের অন্যান্য সকল স্তুরে রাসূল (সা.) নির্দেশিত কোরআন ও সুন্নাহর পথ ও পদ্ধতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই। এতেই রয়েছি শ্রমিক মালিক সহ সকলের ন্যয় সঙ্গত অধিকার ও কল্যাণ।

সূত্র: স্ক্রিপ ডর্ট অর্গ, ইসলামিক লেবার কোড

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03