ফিলিস্তিনের ইতিহাসফিলিস্তিনের ইতিহাস


ইসলামী বার্তা ডেস্ক
Published: 2024-10-05 23:57:46 BdST | Updated: 2024-10-16 14:51:56 BdST

ফিলিস্তিনের ইতিহাস

ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। এটি ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইহুদি ধর্মের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতি দ্বারা শাসিত এবং পরিচালিত হয়েছে। এ ভূখণ্ডের অন্যান্য নামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কনান, জায়ন, ইসরায়েলের ভূমি, দক্ষিণ সিরিয়া, এবং পবিত্র ভূমি।

প্রাচীন ফিলিস্তিন

ফিলিস্তিন অঞ্চলের ইতিহাস প্রাচীন কালের থেকে শুরু হয়েছে, যখন কেনানীয়, আরামীয়, প্রাচীন মিশরীয়, ইসরায়েল বংশের ইহুদি, ব্যাবিলনীয় এবং পারসীয়রা এই অঞ্চল শাসন করত। এই ভূখণ্ডে কৃষিনির্ভর সমাজ এবং সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ব্রোঞ্জ যুগের শুরুতে ফিলিস্তিন অঞ্চলে কেনানীয় নগর-রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল এবং এই সময়ে মিশর, মেসোপটেমিয়া, এবং অন্যান্য সভ্যতার প্রভাব ফিলিস্তিন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

ব্রোঞ্জ যুগে ইহুদিদের আগমন

ব্রোঞ্জ যুগে ইহুদি সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে। তাদের নেতা ছিলেন আব্রাহাম (ইব্রাহীম আঃ), যিনি উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। পরে তার বংশধররা ফিলিস্তিন অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেন এবং এর পরবর্তী সময়ে মিশরে যাওয়ার পর তাদের দাসত্ব শুরু হয়। পরবর্তীতে মুসা (মূসা আঃ) তাদেরকে মিশর থেকে মুক্ত করে সিনাই উপদ্বীপে নিয়ে যান।

ইসরায়েল রাজ্য

হিব্রু নেতা দায়ূদ (দাউদ আঃ) ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেরুজালেম নগরী গড়ে তোলেন। এরপর ইসরায়েল ও যিহূদা যুক্তরাজ্য নামে একটি শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পুত্র শলোমন এই রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করেন। তবে পরবর্তীতে রাজ্যটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

নব্য-অ্যাসিরীয় এবং পারসীয় শাসন

৭০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিলিস্তিন নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং অনেক ইহুদিকে বন্দি করা হয়। পারস্যের সম্রাট মহান কুরুশ অ্যাসিরীয়দের পরাজিত করে ইহুদিদের মুক্ত করেন এবং তাদের ফিলিস্তিনে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন।

রোমান শাসনামল

ফিলিস্তিন রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যায় এবং এই সময়ে ইহুদিদের সঙ্গে রোমানদের বিভিন্ন সংঘর্ষ ঘটে। পরবর্তীতে, রোমান সম্রাটরা ইহুদিদের বিতাড়িত করেন এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটে।

প্রাথমিক মুসলিম শাসন এবং ক্রুসেডীয় যুগ

মুসলিম খিলাফতের অধীনে ফিলিস্তিন অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়। তবে ক্রুসেডীয় যুগে খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের সঙ্গে মুসলিম শাসকদের সংঘর্ষ ঘটে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির নেতৃত্বে মুসলিমরা ক্রুসেডারদের পরাজিত করে এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে।

উসমানীয় শাসনামল

ফিলিস্তিন দীর্ঘ সময় উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছিল। তবে উসমানীয় শাসন শেষ হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অঞ্চলটি ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আসে।

ইহুদি অভিবাসন এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭):

১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration) ছিল একটি ঐতিহাসিক নথি, যা ইহুদি জাতির জন্য ফিলিস্তিনে একটি "জাতীয় আবাসভূমি" প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর কর্তৃক জায়নবাদী নেতা লর্ড রথচাইল্ডের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠির আকারে প্রকাশিত হয়।

বেলফোর ঘোষণার মূল অংশে বলা হয়:

“ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে, তবে এমনভাবে যেন সেখানে বসবাসরত অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।”

এই ঘোষণাটি ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও এটি সরাসরি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলেনি, তবে ইহুদিদের জন্য ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে একটি স্থায়ী আবাসভূমি গঠনের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল। জায়নবাদী আন্দোলনের নেতা থিওডর হারজেল এবং তাঁর অনুসারীরা এই ঘোষণাকে একটি বড় বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন।

ঘোষণার পটভূমি ও প্রভাব:
জায়নবাদী আন্দোলন: ১৯শ শতাব্দীর শেষ দিকে শুরু হওয়া জায়নবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইহুদি জনগণের জন্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে সমর্থন দিতে আগ্রহী হয়, কারণ এটি ইহুদি জনগণের সমর্থন পাওয়ার কৌশল হিসেবে দেখা হয়েছিল।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন ফিলিস্তিনকে নিয়ন্ত্রণে নেয়, যা পরে "ব্রিটিশ ম্যান্ডেট" নামে পরিচিত হয়। এই সময় ব্রিটিশরা বেলফোর ঘোষণার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনকে উৎসাহিত করে।

আরবদের প্রতিক্রিয়া: বেলফোর ঘোষণা আরবদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে, কারণ এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা পরে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। ফিলিস্তিনে বসবাসরত আরবদের মধ্যে এটিকে একটি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হয়, কারণ তাদের ভূমিতে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

ফিলিস্তিনের বিভাজন: ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেলফোর ঘোষণা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এই ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনের পথ প্রশস্ত হয়, যার ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিনি আরবদের বিপর্যয়, যা ‘নাকবা’ নামে পরিচিত।

সারসংক্ষেপ:
বেলফোর ঘোষণা ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি।

জাতিসংঘের প্রস্তাব (১৯৪৭):
ফিলিস্তিনের উপর ইহুদি ও আরবদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের মুখে, জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (UN Partition Plan) প্রস্তাব করে। এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনকে দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করার কথা বলা হয়:

একটি ইহুদি রাষ্ট্র (ইসরায়েল)।
একটি আরব রাষ্ট্র (ফিলিস্তিন)।
তাছাড়া, জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে রাখার প্রস্তাবও করা হয়, যেটি কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে না।

ইহুদিরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেও, ফিলিস্তিনের আরবরা এবং আরব দেশগুলো এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করেছিল, এই প্রস্তাব তাদের অধিকারের উপর আঘাত হানছে এবং এটি অপ্রত্যাশিতভাবে ইহুদিদের পক্ষে ঝুঁকে গেছে, কারণ ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য প্রস্তাবিত অঞ্চলটি তাদের মোট জনসংখ্যার তুলনায় বেশি ছিল।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এবং ইহুদি অভিবাসন (১৯২০):
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আসে। এই সময়ে ইহুদি জনগণের ব্যাপক অভিবাসন শুরু হয়, যা আরব জনসংখ্যার মধ্যে উত্তেজনা এবং সংঘাত বৃদ্ধি করে। উভয় পক্ষের মধ্যে দাঙ্গা, হামলা ও প্রতিশোধমূলক আক্রমণ এই সময়ের মধ্যে শুরু হয়।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৮):
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার পরে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো যেমন, মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, এবং ইরাক, ইসরায়েলের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়, যা ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

ফলাফল:
ইসরায়েল এই যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং পূর্বের বিভাজন পরিকল্পনার তুলনায় আরও বড় অঞ্চল অধিকার করে। যুদ্ধের পর, ফিলিস্তিনের আরবদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কোনো সুযোগ আর থাকেনি।

ফিলিস্তিনের হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, যা ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংকট নামে পরিচিত। এই শরণার্থীদের অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়, এবং তারা আর কখনও তাদের ভূমিতে ফিরে যেতে পারেনি।

পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে আসে, আর গাজা উপত্যকা মিশরের অধীনে চলে যায়।

এই ঘটনাটি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, এবং আজও এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থায়ী বিরোধ ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হিসেবে বিদ্যমান।

আল-নাকবা শুরু (১৯৪৮ সালের ১৪ মে):

ইহুদি অভিবাসনের ফলে ফিলিস্তিনি আরবদের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণার পরপরই আল-নাকবা শুরু হয়। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় আশপাশের দেশগুলোতে। আজকের দিন পর্যন্ত এই বিপর্যয়ের ক্ষত গভীর।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এর ৭৫ বছর পূর্তি পালিত হলেও ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি বিপর্যয়ের স্মারক হয়ে রয়ে গেছে।

ছয় দিনের যুদ্ধ (১৯৬৭):

১৯৬৭ সালের জুনে, ইসরায়েল এবং আশেপাশের আরব দেশগুলোর মধ্যে আরেকটি সংঘাত শুরু হয়। মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ইসরায়েল মিসর, জর্দান এবং সিরিয়ার বিশাল এলাকা (গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান মালভূমি) দখল করে নেয়। এই যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলির প্রশ্নে আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত হয়ে ওঠে।

মিউনিখ হত্যাকাণ্ড (১৯৭২):

১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক গেমসে, ১১ জন ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদকে হত্যা করে। এই ঘটনা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে বৈশ্বিক পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি (১৯৭৮):

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় এবং এর বিনিময়ে ইসরায়েল মিসরের দখলকৃত সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেয়। এটি ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের প্রথম শান্তি চুক্তি।

প্রথম ইন্তিফাদা (১৯৮৭):

১৯৮৭ সালে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রথম বৃহৎ বিদ্রোহ বা "ইন্তিফাদা" শুরু হয়।  প্রথম ইন্তিফাদার সময়কাল (১৯৮৭-১৯৯৩)। এটি ছিল পাথর নিক্ষেপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আক্রমণের একটি ধারাবাহিকতা, যা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের দাবি ও ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে শুরু হয়েছিল।

অসলো শান্তি চুক্তি (১৯৯৩):

১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার কিছু অংশে ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং এটি ছিল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার একটি বড় পদক্ষেপ। তবে, চুক্তির পরও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি এবং সহিংসতা অব্যাহত থাকে।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০):

২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়, যা প্রথম ইন্তিফাদার চেয়ে অনেক বেশি সহিংস ও রক্তক্ষয়ী ছিল। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়কাল (২০০০-২০০৫)  এটি আরব ও ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মঘাতী বোমা হামলা, ইসরায়েলের সামরিক প্রতিক্রিয়া ও গণহত্যার মতো ঘটনা নিয়ে গঠিত ছিল।

গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার (২০০৫)

২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে তাদের সকল বসতি এবং সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহার করে নেয়। তবে, এই অঞ্চলটি পরে হামাসের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যা ইসরায়েলের সঙ্গে নতুন সংঘাতের সূত্রপাত করে।

গাজা যুদ্ধ - অপারেশন কাস্ট লিড(২০০৮): 
সময়কাল: ২৭ ডিসেম্বর ২০০৮ – ১৮ জানুয়ারি ২০০৯

মূল কারণ: হামাসের রকেট এবং মর্টার হামলা ইসরায়েলের বেসামরিক এলাকাগুলোতে ক্রমাগত আঘাত হানার পর ইসরায়েল অপারেশন "কাস্ট লিড" শুরু করে। ইসরায়েলের দাবি ছিল, এই অভিযান হামাসের রকেট নিক্ষেপ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছিল।

মূল ঘটনা:ইসরায়েল গাজার ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়, যা পরে স্থল অভিযানেও রূপ নেয়।
হামাস এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েল লক্ষ্য করে হাজার হাজার রকেট ছোঁড়ে।
তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই সংঘাতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

ফলাফল: ১,৪০০-১,৫০০ এর অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে অনেক বেসামরিক ব্যক্তি ছিল।
১৩ জন ইসরায়েলি নিহত হয়।
যুদ্ধ শেষে, গাজার অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয় এবং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকে।

গাজা যুদ্ধ : অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্স (২০১২): 
সময়কাল: ১৪ নভেম্বর ২০১২ – ২১ নভেম্বর ২০১২

মূল কারণ:হামাসের সামরিক কমান্ডার আহমেদ জাবারির হত্যার পর গাজা থেকে ইসরায়েলের দিকে রকেট হামলার বৃদ্ধি ঘটে, যার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল গাজায় নতুন অভিযান শুরু করে। ইসরায়েল দাবি করে, এই হত্যাকাণ্ড ছিল হামাসের নেতৃত্বকে দুর্বল করার একটি পদক্ষেপ।

মূল ঘটনা: ইসরায়েল গাজার বিভিন্ন জায়গায় বিমান হামলা চালায়, বিশেষ করে হামাসের রকেট উৎক্ষেপণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে।
হামাস এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় রকেট হামলা চালায়।
ইসরায়েল "আয়রন ডোম" ব্যবস্থার মাধ্যমে রকেটগুলোকে বাধা দেয়।

ফলাফল:
আট দিনের সংঘাতে প্রায় ১৬০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে অনেক বেসামরিক ছিল।
ইসরায়েলের পাঁচজন নিহত হয়।
মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং সাময়িক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

গাজা যুদ্ধ - অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ(২০১৪): 
সময়কাল:৮ জুলাই ২০১৪ – ২৬ আগস্ট ২০১৪

মূল কারণ:
গাজা থেকে ইসরায়েলের দিকে হামাসের রকেট হামলা এবং তিনজন ইসরায়েলি কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে।

মূল ঘটনা:
ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা এবং স্থল অভিযান চালায়, যেখানে হামাসের সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা ধ্বংস করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এবং হামাসের মধ্যে বড় আকারের সংঘর্ষ ঘটে।
গাজা থেকে ইসরায়েলে রকেট হামলা অব্যাহত থাকে, যা "আয়রন ডোম" দ্বারা অনেকাংশে প্রতিহত করা হয়।
ফলাফল:
২,২৫১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে অধিকাংশ বেসামরিক।
৭৩ ইসরায়েলি নিহত হয়, যার মধ্যে ৬৭ জন সেনা সদস্য।
গাজার অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং দুই পক্ষের মধ্যে স্থায়ী সমাধান ছাড়াই একটি যুদ্ধবিরতি হয়।

আব্রাহাম চুক্তি (২০২০):

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব দেশ—সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো—ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। তবে ফিলিস্তিনিরা এই চুক্তিকে তাদের সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে, কারণ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান না করেই ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

গাজা যুদ্ধ - অপারেশন গার্ডিয়ান অফ দ্য ওয়ালস(২০২১): 
সময়কাল:১০ মে ২০২১ – ২১ মে ২০২১

মূল কারণ:জেরুজালেমের শেখ জাররাহ এলাকায় ফিলিস্তিনি পরিবারদের উচ্ছেদ এবং আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি পুলিশ ও ফিলিস্তিনি উপাসকদের মধ্যে সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের দিকে রকেট নিক্ষেপ শুরু করে।

মূল ঘটনা:
ইসরায়েল গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ গ্রুপের অবস্থানে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়।
হামাস হাজার হাজার রকেট ইসরায়েলে নিক্ষেপ করে, যার অনেকগুলোকে ইসরায়েলের "আয়রন ডোম" প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিহত করে।
ইসরায়েলি হামলায় গাজার বহুতল ভবন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়।
ফলাফল:
২৫৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৬৬ জন শিশু ছিল।
১৩ ইসরায়েলি নিহত হয়, যার মধ্যে একজন শিশু।
১১ দিনের যুদ্ধের পর মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়, কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি এবং পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত।

গাজা যুদ্ধ - অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড(২০২৩): 
সময়কাল:৭ অক্টোবর ২০২৩ – চলমান

মূল কারণ:২০২৩ সালের গাজা যুদ্ধটি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি নতুন মাত্রার সংঘর্ষ হিসেবে শুরু হয়। এই যুদ্ধের মূল কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা যেতে পারে:

আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ: জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনি উপাসকদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের প্রেক্ষিতে উত্তেজনা বাড়ে। এই মসজিদটি মুসলিমদের কাছে পবিত্র এবং সেখানে ইসরায়েলি কার্যক্রম ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়।

ফিলিস্তিনি ভূমি দখল: পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ, ফিলিস্তিনি উচ্ছেদ, এবং অব্যাহত সামরিক অভিযানগুলো ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ তৈরি করে।
গাজায় অবরোধ ও মানবিক সংকট: ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, যা গাজার অর্থনীতি এবং জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। দীর্ঘমেয়াদি এই অবরোধের ফলে গাজার জনগণের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।

মূল ঘটনা:
৭ অক্টোবর ২০২৩: হামাস হঠাৎ করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে "অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড" নামে একটি বড় ধরনের আক্রমণ চালায়। এতে হামাসের হাজার হাজার রকেট ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করা হয়।

ইসরায়েলে হামাসের হামলা: এই অভিযানে হামাস ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটি ও বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের মধ্যে ঢুকে বিভিন্ন শহরে আক্রমণ চালায় এবং ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা ও বন্দি করে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া: ইসরায়েল এর পরপরই গাজার ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী "আয়রন ডোম" ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক রকেট প্রতিহত করলেও গাজা থেকে আসা রকেট হামলা অব্যাহত থাকে।

মানবিক সংকট: গাজা যুদ্ধের ফলে সেখানে মানবিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে ওঠে। পানির সংকট, খাদ্য ঘাটতি এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা ঘটে, যা গাজার জনগণকে অত্যন্ত দুর্দশায় ফেলে।

ফলাফল:
বিপুল প্রাণহানি: ইসরায়েল ও গাজা উভয় পক্ষেই প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেক বেসামরিক নাগরিক, নারী ও শিশু রয়েছে। ইসরায়েলেরও বিপুল ক্ষতি হয়েছে, বিশেষ করে হামাসের আক্রমণে অনেক ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান: ইসরায়েল গাজার ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে, হামাসের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করেছে, এবং গাজা শহরের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: এই সংঘাতের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই পক্ষকে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে এবং যুদ্ধের সমাপ্তি কবে হবে তা অনিশ্চিত।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03