ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ইসলাম
ইসলামী বার্তা ডেস্ক
Published: 2024-10-10 23:56:43 BdST | Updated: 2024-10-16 06:19:42 BdST
[ছবি: টোবাগোর লল্যান্ডে অবস্থিত তাওবাহ মসজিদ]
১৪শ শতকের শুরুর দিকে আফ্রিকার সেনেগাম্বিয়ান অঞ্চল থেকে মুসলিমদের একটি দল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে পৌঁছে। তারা সম্ভবত মুর মুসলিম ছিলেন, যারা স্পেন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল এবং নতুন ভূমিতে আশ্রয় খুঁজতে ক্যারিবিয়ান ও মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলে যাত্রা শুরু করেছিল।
মুরদের প্রভাব ও সম্ভাব্য আগমন:
মুররা ছিল উত্তর আফ্রিকার বারবার ও আরব মুসলিম, যারা মধ্যযুগে স্পেন এবং পর্তুগালের একটি বড় অংশ শাসন করেছিল। স্পেনে বা আল-আন্দালুসে ইসলামিক শাসন প্রায় ৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু ১৪৯২ সালে গ্রানাডা পতনের মাধ্যমে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে, এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নিপীড়ন শুরু হয়। অনেক মুসলিমকে হত্যা করা হয়, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়, অথবা তাদের ভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
[পুয়ের্তো রিকোর আলেজান্দ্রো ইসমাইল, যে ১৩ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছে]
সেনেগাম্বিয়ান অঞ্চলের মুসলিমদের ভূমিকা:
পশ্চিম আফ্রিকার একটি অংশ সেনেগাম্বিয়া অঞ্চল যা আজকের সেনেগাল এবং গাম্বিয়া অঞ্চলকে বোঝায়, যেখানে ইসলাম বেশ আগে থেকেই প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১১শ শতক থেকেই ইসলাম এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলের মুসলিমদের সঙ্গে মুরদের যোগাযোগ ছিল, এবং কিছু মুর মুসলিমগণসেনেগাল ও গাম্বিয়ার মুসলিমদের মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকা হয়ে আমেরিকায় যাত্রা করেছিল।
সমুদ্রযাত্রার সম্ভাব্য পথ:
মুর এবং সেনেগাম্বিয়ান মুসলিমরা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে পৌঁছেছিল। ঐতিহাসিক তথ্য ও লোককথা অনুসারে, আফ্রিকান এবং মুসলিম অভিযাত্রীরা ইউরোপীয় নাবিকদের আগেই আমেরিকার উপকূল বরাবর বিভিন্ন স্থানে পৌঁছেছিল। সেনেগাম্বিয়ান মুসলিমরা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং মেক্সিকো উপসাগরীয় উপকূলে তাদের উপস্থিতি স্থাপন করেছিল। তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় করেছিল।
প্রমাণের সীমাবদ্ধতা:
এ বিষয়ে অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনও অপ্রতুল, এবং এটি একটি বিতর্কিত মতবাদ হিসেবে থেকে গেছে। তবে, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল এবং আমেরিকার মধ্যে প্রাক-কলম্বিয়ান যোগাযোগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন, মুসলিম অভিযাত্রীরা আমেরিকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব রেখেছিল।
সার্বিকভাবে, এটি নিশ্চিত করা কঠিন হলেও, আফ্রিকার সেনেগাম্বিয়ান মুসলিমদের প্রাক-কলম্বিয়ান যুগে আমেরিকায় উপস্থিতি এক ধরনের ঐতিহাসিক তত্ত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পরবর্তী গবেষণায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারে।
[হাইতির একটি মসজিদ: মসজিদে আবু বকর (রা.)]
ক্যারিবিয়ান দেশ সমূহে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা:
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যার হার কিছু দেশে উল্লেখযোগ্য। তবে আন্টিগুয়া ও বারবুডা, বাহামা, বার্বাডোস, বেলিজ, কিউবা, ডোমিনিকা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, গ্রেনাডা, গায়ানা, হাইতি, জ্যামাইকা, সেন্ট কিটস ও নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও দ্য গ্রেনাডাইনস এই দেশ সমূহ সহ আরো কিছু অঞ্চল আঙ্গুইলা, বারমুডা, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, কায়মান দ্বীপপুঞ্জ, মন্টসেরাট, তুর্কস ও কাইকোস, গুয়াডেলোপ, মার্টিনিক, আরুবা, কুরাসাও, পুয়ের্তো রিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ প্রভূতি দেশ ও অঞ্চল সমূহে মুসলিমদের সংখ্যা .১% থেকে ৩% এর মধ্যে। সুরিনামে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১৫%, যা এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ, গায়ানায় প্রায় ৭%, এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে প্রায় ৬%।
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা খুবই কম হলেও, প্রতিটি স্থানে তাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য আলাদা আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে। নিচে দেশভিত্তিক কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:
আন্টিগুয়া ও বারবুডা, বাহামা, বার্বাডোস, বেলিজ, ডোমিনিকা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, গ্রেনাডা, জ্যামাইকা, সেন্ট কিটস ও নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও দ্য গ্রেনাডাইনস: এই দেশগুলোতে মুসলিম জনসংখ্যা খুবই নগণ্য, প্রায় ০.৩%। এখানে মুসলিমরা মূলত অভিবাসী বা বাণিজ্যের সাথে জড়িত সম্প্রদায়। মুসলিমদের সংখ্যা কম হলেও তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশীলন বজায় রাখার জন্য ছোট ছোট মসজিদ ও ইসলামিক কেন্দ্র রয়েছে।
গায়ানা: গায়ানায় মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৭%। এখানে মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিমদের প্রাধান্য রয়েছে, যারা ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় ভারত থেকে শ্রমিক হিসেবে এসেছিল। গায়ানায় ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা ধর্মীয় ছুটি হিসেবে পালন করা হয়, যা স্থানীয় সরকার দ্বারা স্বীকৃত।
হাইতি: হাইতিতে মুসলিম জনসংখ্যা খুবই কম, প্রায় ০.১%। এই মুসলিমদের বেশিরভাগই অভিবাসী সম্প্রদায়, এবং ইসলাম স্থানীয় ধর্মগুলোর পাশাপাশি ছোট পরিসরে পালিত হয়।
বারমুডা, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, কায়মান দ্বীপপুঞ্জ, মন্টসেরাট, তুর্কস ও কাইকোস, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ: ব্রিটিশ ও আমেরিকান অধীন এই দ্বীপগুলোতে মুসলিম জনসংখ্যা খুব কম। প্রবাসী মুসলিমদের উদ্যোগে কিছু মসজিদ স্থাপন করা হয়েছে এবং তাতে মুসলিমরা ধর্মীয় বিধি বিধান পালন করেন।
সুরিনাম: এই অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৫%। সুরিনামে মুসলিমদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বেশ শক্তিশালী, এবং মুসলিমরা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঈদ উপলক্ষে জাতীয় ছুটি এবং ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
পুয়ের্তো রিকো: পুয়ের্তো রিকোতে মুসলিমদের মাঝে ক্রমশ ইসলামের চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিমদের জন্য কিছু মসজিদ ও ইসলামিক কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে নামাজ ও ধর্মীয় শিক্ষা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে পুয়ের্তো রিকোর কাগুয়াস শহরে অধিকাংশ মুসলমান বসবাস করছেন। মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমাজে সুনাম রয়েছে, এবং তারা আরব ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অনেক ধনী মুসলিম এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, অন্যরা ব্যবসায়িক কারণে সাময়িক ভ্রমণ করেন। এছাড়া, অনেক মুসলিম এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন এবং অধ্যাপনায়ও যুক্ত রয়েছেন।
কিউবা: কিউবায় মুসলিম জনসংখ্যার হার খুবই কম, প্রায় ০.১% এর মতো। যদিও কিউবায় ধর্মীয় স্বাধীনতা সীমিত, মুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় চর্চার জন্য একটি ইসলামিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছে এবং ক্রমশ ইসলামের চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লেখক: তৌফিক হাসান
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: