সূরা আল-কাহাফ থেকে মূল্যবান শিক্ষা


ড. স্প্যাহিক ওমের
Published: 2024-08-05 05:00:05 BdST | Updated: 2024-09-28 07:29:41 BdST

মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা যে সমস্ত ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তার প্রত্যেকটি ঘটনাতেই আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সূরা আল-কাহাফও স্থায়ী এবং চির-নতুন শিক্ষায় পরিপূর্ণ। 

যদিও সূরাটিকে আল-কাহাফ (যার অর্থ গুহা) বলা হয়, তবে এতে উপস্থাপিত বার্তাটি হল যে ইসলামিক বাণীর সফল এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন গুহা, সন্ন্যাস, কঠোর তপস্বী, বিচ্ছিন্নতা এবং অতিরিক্ত আদর্শবাদের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর কারণ হল ইসলাম একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম, ব্যাপক শ্রেষ্ঠত্ব, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধর্ম। এটি একটি সম্মিলিত প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন এবং মিশন, যেমন একটি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং অভিজ্ঞতা। তাই, জামা'আহ (সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং ঐক্য ), ভ্রাতৃত্ব , ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, সততা, দয়া , পরোপকার এবং সাধারণভাবে অন্যদের জন্য দরকারী এবং উপকারী হওয়ার মতো ধারণা সমূহ ইসলামে সর্বোত্তম।

একজন সত্যিকারের মুসলিম হওয়ার অর্থ হল নিরন্তর সৎকর্মশীল হওয়া। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সকল স্তরে এর মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠা এবং অন্যদের জন্য সমস্ত ধার্মিকতা ও পুণ্যের উৎস ও বাহক হওয়া। ইসলামকে কখনই একটি বিমূর্ত দর্শন, একটি নিছক বাগ্মীতা, অবাস্তব আদর্শ ও মানদণ্ডের ধর্ম বলে বোঝানো হয়নি। এ কারণেই ইসলামকে বলা হয়, বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছা ও কর্তৃত্বের কাছে নিজের পূর্ণ সত্তাকে আত্মসমর্পণ করা। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বের বিধান হিসেবেও আমাদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী জীবন যাপন করা নয়, বরং আমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং জীবনের স্রষ্টা ও তত্ত্বাবধায়কের পরম ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী জীবনযাপন করা।

সুতরাং, যখন আসহাবে কাহাফবাসীরা গুহায় গিয়েছিল, তখন তারা এমনটি করেছিল কারণ তারা এমনটি চেয়েছিল বা পরিকল্পনা করেছিল, বরং তারা তাদের অবিশ্বাসী লোকদের থেকে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের জীবনযাপনের অবস্থা এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে তাদের ইমান রক্ষা করতে এবং তাদের জীবন বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত তাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল।

কী ঘটছে এবং কেন তারা গুহা আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে সচেতন হওয়ার পরে, তারা উভয়ই শান্তভাবে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের সমস্ত বিষয়ের নিয়ন্ত্রক আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছিল এভাবে: আমাদের প্রভু! আমাদেরকে আপনার নিজের পক্ষ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকে সঠিকভাবে পরিচালনা করুন! (আল-কাহাফ ১৮: ১০ )।

এমনকি তারা গুহায় নিজেদের বসতি স্থাপন করার পরেও, গুহা নিদ্রাবাসীরা জানত যে তাদের লোকেরা যদি তাদের সম্পর্কে জানতে পারে তবে তারা তাদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করবে বা তাদের অপব্যবহার ও ক্ষতি করবে, তাদের মুশরিক বিশ্বাস ও অনুশীলনে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যে ক্ষেত্রে তারা কখনই সফল হতে পারে না (আল-কাহাফ, ২০)।

গুহায় পালানোর আগে, আসহাবে কাহাফবাসী খুব সক্রিয় ছিল বলে মনে হয়, খোলাখুলিভাবে জীবনযাপন করে এবং শিরকের প্রপঞ্চ এবং এর বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের তাওহীদিক (একশ্বরবাদী) বার্তা প্রচার করতো। তারা জানত যে গুহায় তাদের নতুন জীবনধারা শুধুমাত্র একটি প্রয়োজনের কারণে এবং এটি কোনওভাবেই আদর্শ বা বাধ্যতামূলক নয়। তারা আরও জানত যে, এটি প্রকৃতিগতভাবে অস্থায়ী ছিল এবং আল্লাহ, তাদের পালনকর্তা, শীঘ্রই তাদের জন্য তাঁর রহমত থেকে একটি পথ খুলে দেবেন, তাদের হেদায়েত বৃদ্ধি করবেন এবং তাদের জন্য তাদের কঠিন পরিস্থিতি সহজ করে দেবেন।

তথাপি, গুহা নিদ্রার ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান আল্লাহ একটি সম্ভাব্য উচ্চতর উদ্দেশ্য এবং অর্থ অর্জনের জন্য ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ, মানুষের আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও সমৃদ্ধি এবং তাদের সামাজিক ধর্মীয় ও নৈতিক সংস্কার পূর্বের ভিত্তিতে।

সংক্ষেপে সূরা কাহাফ থেকে আমরা যে শিক্ষাসমূহ পাই তা হচ্ছে: 

-তাওহীদকে মেনে নেওয়া মানুষের ফিতরাতি তথা সৃষ্টিগত স্বভাব। অর্থাৎ কোন মানুষকে যদি তার স্বভাজাত ধর্মের উপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাইরের কোন গোমরাহ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে বিভ্রান্ত না করে, তাহলে সে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিবে, তারই ইবাদত করবে এবং তাঁর ইবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। যেমনটি হয়েছেলি ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের ক্ষেত্রে।

-পৃথিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় যুবকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

-মূর্তি পূজা, অলী-আওলীয়াদের পূজা এবং শির্কের পক্ষে কোন দলীল নেই।

-প্রয়োজনে সত্য গোপন করা জায়েয আছে। কিন্তু তা সকল সময়ের জন্য নয়।

-সাহসের সাথে তাওহীদের বাণী প্রকাশ্যে প্রচার করা জরুরী।

-নিজ দেশে দ্বীন পালন করতে গিয়ে ফিতনার ভয় থাকলে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করা আবশ্যক।

-আসহাবে কাহাফের ঘটনা আল্লাহর বিশেষ একটি বড় নিদর্শন। তবে তার চেয়েও বড় নিদর্শন হচ্ছে, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্যের সৃষ্টি এবং দিবা রাত্রির আগমণ ও প্রস্থান।

-বিপদাপদে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর দয়া কামনা করা জরুরী।

-কোন মতবাদ, মাজহাব ও আমল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কারও অন্ধ অনুসরণ না করে দলীল অনুসন্ধান করা জরুরী।

-আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের খেদমতের জন্য বড় বড় মাখলুককে বাধ্য করেন।

-দ্বীনের পথে আহ্বানকারীরা প্রয়োজনে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। বিশেষ করে যখন তাঁর পিছনে শত্রুরা ষড়যন্ত্র শুরু করে।

-সুখে-দুঃখে হালাল জীবিকা অনুসন্ধান করা জরুরী।

-বিনা প্রয়োজনে মতভেদ করা অর্থহীন। যেমন গুহাবাসীদের নাম, কুকুরটির নাম ও তার রং সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করে কোন লাভ নেই। তারা সংখ্যায় ছিলেন ছয় না সাত জন। এই সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয় যেকারণে মহান আল্লাহ তাআলা সংখ্যার বিষয় স্পষ্ট করেন নি। আসহাবে কাহাফের স্থান ও কাল কুরআন ও সহীহ হাদীছে উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং তা খুঁজে বেড়ানোতে আমাদের কোন লাভ নেই।

-প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব অপরিসীম।

-তাওহীদ ও শির্কের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা অর্জন করা জরুরী। অন্যথায় তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়।

-তিন শত নয় বছর পর তাদেরকে জীবিত করা এটাই প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য, কিয়ামত সত্য। এতে কোন সন্দেহ নেই।

-রূহ এবং দেহ উভয়েরই পুনরুত্থান হবে। কেননা আসহাবে কাহাফগণ এভাবেই জীবিত হয়েছিলেন। -রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের সম্পর্ক অধিক মজবুত হওয়া আবশ্যক। ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের মধ্যে রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ঈমান ও তাওহীদের বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে একই পথের পথিক হয়ে যান।

-হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি বিরাট একটি নেয়ামত। বান্দার উচিত সর্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করা।

-ভাল লোকের সঙ্গে থাকলে ভাল হওয়া যায় এবং ভাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়। কুকুরটি তাদের সাথে থাকার কারণে কুরআনে তার সেটির কথা উল্লেখিত হয়েছে। অপর পক্ষে অসৎ লোকের সঙ্গে থাকলে অসৎ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে নিরাপদ নয়।

-কবরের উপর মসজিদ বা গম্বুজ নির্মাণ করা আমাদের শরীয়তে নিষিদ্ধ।

-বাতিল পন্থীরা সন্দেহ এবং অনুমানের অনুসরণ করে থাকে। সঠিক কোন দলীল তাদের হাতে নেই।

-বয়স বৃদ্ধি হলে এবং অভিজ্ঞতা দীর্ঘ হলেই মানুষ জ্ঞানী হয়ে যায় না। এই যুবকগণ বয়সে কম হলেও তারা সত্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। অথচ সেই জাতির মধ্যে অসংখ্য বয়স্ক ও অভিজ্ঞ লোক থাকা সত্ত্বেও সঠিক পথের সন্ধান পায় নি।

-এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে সূর্য চলমান; স্থির নয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডানদিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়।

-প্রহরী হিসেবে কুকুর প্রতিপালন করা জায়েয আছে।

-আল্লাহ কখনও দ্বীনের দাঈদের ঈমানী শক্তি পরীক্ষা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদেরকে শক্তিশালী করে দেন। তখন দ্বীন প্রচারকারীদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা।

-কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে বলতে হবে আল্লাহই ভাল জানেন।


লেখক : ড. স্প্যাহিক ওমের

ডঃ স্প্যাহিক ওমর, একজন পুরস্কার বিজয়ী লেখক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া (IIUM) এর কুল্লিয়াহ অফ ইসলামিক রিভিলড নলেজ অ্যান্ড হিউম্যান সায়েন্সেস-এর একজন সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বসনিয়া, মিশর এবং মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করেছেন। ২০০০ সালে, তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সভ্যতার ক্ষেত্রে কুয়ালালামপুরের মালয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ইসলামী ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সভ্যতা, সেই সাথে ইসলামী নির্মিত পরিবেশের ইতিহাস ও তত্ত্বও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। তাঁর সাথে যোগাযোগ করার ইমেইল: spahico@yahoo.com।

সূত্র: এ্যাবাউট ইসলাম

মূল আর্টিকেল

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


ইসলামী বিষয়াবলী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে সজীব, তাদের কর্মের কারণে সন্তুষ্ট, তারা থাকবে...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-04-23 23:36:39

রাসূল স. বলেছেনঃ বেশি বেশি কোর’আন তেলা’ওয়াত কর, কেননা হাশরের দিন এ কো...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-08-15 23:24:11

হযরত মুয়াজ (রা.) রাসূল (সা.) এর কাছ থেকে কিয়ামতের দিন প্রথম তিনজন জাহা...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-02-22 00:11:13

মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আপনার উচিত সর্বদা জ্ঞান অর্জনে লিপ্ত থাকা।...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-06-29 08:34:21

"হে আল্লাহ্, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা, দুঃখ, অক্ষমতা, অলসত...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-05-06 13:46:07

হজ্জ্ব ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত। হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতিবছর জি...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-08-16 23:47:11

হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় হাদীসগ্রন্থেই...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-06-22 23:12:36

মুসলিম হওয়া যে জন্মগত কোনো ব্যাপার না, এই কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2019-02-19 23:09:08