এখন দেশের সকল মুসলিমদের সবচেয়ে জরুরী ঈমানী দায়িত্ব বন্যার্তদের রক্ষায় এগিয়ে আসা


তারেক হাসান
Published: 2024-08-24 05:50:59 BdST | Updated: 2024-09-28 07:30:14 BdST

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে ফেনী ও কুমিল্লায় নজিরবিহীন বন্যায় দূর্গত মানুষদেরকে রক্ষায় সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করা এসময় এদেশের প্রত্যেক মুসলিমের সবচেয়ে জরুরী ঈমানী দায়িত্ব। 

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবতা ইসলামের অন্যতম মূলনীতি এবং আবশ্যিক দায়িত্ব। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো, বিপদ মুক্তির জন্য সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। তাদের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা, খাবার-দাবার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসা ঈমানের দাবি। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করাও ফরজ ইবাদত। 

আল্লাহর দয়া পাওয়ার শর্ত বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করা

রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের কেউ শুধু তার আমলের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (১)

অবশ্যই ইবাদতের পাশাপাশি আল্লাহর দয়া জরুরি। আল্লাহ তাদেরকে দয়া করেন যারা বিপদাপন্ন মানুষকে দয়া করে।

হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন না; যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না। (২)

রসুলুল্লাহ (সা.)আরো বলেন, তোমরা জমিনে যারা বসবাস করছে তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (৩)

মহান আল্লাহর আবশ্যিক নির্দেশ

বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করা আল্লাহর নির্দেশ। এটা কোন ঐচ্ছিক কাজ নয়। আর যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের প্রতি অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করতে পবিত্র কুরআনে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সে দিন আসার আগেই যে দিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না। (৪)

রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের অনুসরন

আমরা সে নবীর উম্মত যিনি সমগ্র বিশ্বকে মানবতাবাদ শিখিয়েছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক বর্তমানে ইউরোপ আমেরিকা মানবতাবাদের বাহক সেজে আছে। অপরদিকে মুসিলম জাতি মানবতাবাদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) সব সময় অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। মদিনার আনসার সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানবদেহের মতো; যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তখন তার পুরো দেহ ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।(৫)

উৎকৃষ্টতর বিনিয়োগ

বিপদগ্রস্ত নুষের বিপদে এগিয়ে এসে তাদের জন্য ব্যয় করাকে মহান আল্লাহ তায়ালা উত্তম বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর তিনি তার বহুগুণ প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর সালাত কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু আগে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তররূপে। (৬)

সালাত কবুলের অন্যতম শর্ত

ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার না দিয়ে সালাত আদায় করলে সালাত কবুল হবে না এবং সালাত আদায় করা সত্বেও ভবিষ্যতে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, যারা ইয়াতিমকে তাড়িয়ে দেয়, দরিদ্রদেরকে খাবার দিতে উৎসাহিত করে না, এমন  সব নামাযীরা ধ্বংস হবে। যারা তাদের নামাজের শিক্ষা সম্বন্ধে বে-খবর, যারা তা লোক-দেখানোর নামাজ পড়ে, এবং জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। (৭)

 
অভুক্তকে খাদ্য না দিলে জাহান্নামে যাওয়ার আশংকা

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, জাহান্নামীদেরকে ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করবে, তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে এনেছে? তারা বলবে, আমরা নামায পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দিতাম না।(৮) 

যারা বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য না করে যারা সোনা, রূপা  বা অর্থ সম্পদ জমা করে রাখবে তাদের ভয়াবহ পরিণতি হবে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, যারা সোনা, রূপাকে জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদের কপালে, শরীরের পার্শ্বে ও পিঠে ছেক দেয়া হবে। আর বলা হবে এটা হচ্ছে ঐ সম্পদ যা তোমরা জমা করে রেখেছিলে নিজেদের জন্য । আর ঐ জিনিস জমা রাখার শাস্তি গ্রহন কর।(৯)

আমাদের করণীয়
মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা, ধৈয্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং সালাতের পরই উদ্ধার কাজে অংশ গ্রহণ করা, দূর্গত এলাকার বাসিন্দাদেরকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা, খাবার দেওয়া এবং চিকিৎসা সাহায্য প্রদান করা। উদ্ধারকারী টিম এবং সম্ভব হলে সরাসরি বন্যা কবলিত ব্যক্তি বা পরিবারকে অর্থ সাহায্য দেওয়া। এছাড়াও যেসব টিম কাজ করছে বিশেষত ইসলামী সংগঠন এবং আলেমদের টিম সহ যোগ্য টিম সমূহকে সর্বাত্মক সহযোগীতা প্রদান করা। 

যার যে সাধ্য আছে তা করতে হবে

দূর্যোগ মোকাবেলায় যাদের শ্রম দেওয়ার সাধ্য আছে তাদেরকে শ্রম দিতে হবে। যাদের যাওয়ার সুযোগ আছে যেতে হবে। যাদের অর্থ, খাবার, লাইফ জ্যাকেট, স্পিডবোট, নৌকা, গাড়ী, হেলিকপ্টার ইত্যাদি পাঠানোর সুযোগ আছে তাদেরকে তা পাঠাতে হবে। বাংলাদেশ এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের কোন মুসলিম এ দায়িত্ব থেকে গাফেল থাকার কোন সুযোগ নেই।

মুসলিম অমুসলিম সবাইকে সাহায্য করতে হবে

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুদেরকে উদ্ধারের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে বলেছেন। তারা মুসলিম হোক বা অমুসলিম, তা বিবেচ্য বিষয় নয় (১০)। পবিত্র কোরআনে অমুসলিমদের মধ্যে যাদেরকে সঠিক ভাবে সতর্ক করা হয়নি তাদেরকে গাফেল বলা হয়েছে (১১)। সতর্ককারী বা বার্তাবাহক যায়নি এমন গাফেলদেরকে আল্লাহ শাস্তি প্রদান করবেন না, তারা অমুসলিম হলেও। এমনকি তাদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছে যারা ঈমান গোপন রাখে। তারা আল্লাহ তায়ালার কাছে মুমিন হিসাবে গণ্য হবে। এছাড়া মানুষের ইমান না আনার কারণে নয় বরং জনপদ সমূহ তখনই ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যখন বাসিন্দারা জুলুম করে। সুতরাং অমুসলিমদেরকে সাহায্য করা উচিত যদি তারা বিপদগ্রস্থ হয়। 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এর ঘরে একটি বকরি জবাই করা হল। খাবার রান্না হলে তিনি চাকরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে কি এ থেকে খাবার দিয়েছ? (১২)

হযরত উমর (রা.) যখন রাষ্ট্রের খলীফা ছিলেন তখন একদিন এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন মসজিদের দুয়ারে ভিক্ষা করছে। তখন তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তার প্রয়োজনীয় ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। (১৩)

সুতরাং বর্তমানে বন্যা দূর্গত এলাকায় ধর্ম বর্ণ নির্বেশেষে সবাইকে সাহায্য করা আল্লাহর নির্দেশ, রাসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের আদর্শ। মনে রাখতে হবে, তাঁদের সকল যুদ্ধ ও লড়াই ছিল সীমালংঘনকারী ও জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে। নিছক কোন অমুসলিমের বিরুদ্ধে নয়।

কোন প্রতিদান, বিনিয়ম ও স্বার্থ হাসিলের ইচ্ছা রাখা যাবে না

অনেকেই ভাইরাল হওয়া, ছবি তোলা বা মানবিক হিসাবে নিজেকে জাহির করার জন্য উদ্ধার কর্মসূচীতে অংশ নেয়। এটা মুমিনের বৈশিষ্ট নয়। তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এমন যাহা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না (১৪)। অপরদিকে  যারা এরকম লোক দেখানোর জন্য কাজ করে তারা প্রকৃত পক্ষে এক ধররেন শিরকে নিমজ্জিত।

পরিশেষে বলতে হয়, আলহামদুলিল্লাহ, এবারের বন্যার ভয়াবহতা যেমন বেশি, তেমনি বাংলাদেশের আপামর ছাত্র জনতার উদ্ধার কাজে অংশ গ্রহণও অনেক বেশি।  অন্যান্য সময় কিছু ইউটিউবার, সেলিব্রেটি বা সরকারী, বেসরকারী সংস্থাকে ত্রান কার্যক্রমে দেখা যেত, তাদের অধিকাংশিই মিডিয়া কভারেজ বা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজ করতো। কিন্তু এবারে সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-জনতার অংশ গ্রহণ যেমন ব্যাপক এবং স্বতস্ফুর্ত।  

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে উদ্ধার ও সহায়তা কাজে অংশ নেওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন। 


রেফারেন্স

১। মুসনাদে আহমাদ: হাদীস নং ৭৪৭৯,

২। আল-বুখারি হাদিস: ৪৯৪১,

৩। সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৪৯৪১,

৪। সূরা বাকারা: আয়াত ২:২৫৪,

৫। আল-মুসলিম: হাদিস ৬৪৮০,

৬। সূরা বাকারা: আয়াত ২:২৪৫,

৭। সূরা মাউন: ১০৭ : ২-৭,

৮। সূরা আল মুদ্দাস্সির: ৭৪ : ৪২-৪৪,

৯। সূরা তওবাহ, আয়াত ৩৯: ৪-৩৫,

১০। সূরা নিসা ৪:৭৫,

১১। সূরা ইয়াসীন ৫৬: ৬

১২। সূরা মুমিন, ৪০:২৮, সূরা ইসরা: ১৫, সূরা কাসাস: ৫৯,

১৩। জামে তিরমিযী: ১৯৪৩, কিতাবুল আমওয়াল: ১৭৯,

১৪। সূরা দাহর: আয়াত ৭৬: ৮-৯। 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


ইসলামী বিষয়াবলী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে সজীব, তাদের কর্মের কারণে সন্তুষ্ট, তারা থাকবে...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-04-23 23:36:39

রাসূল স. বলেছেনঃ বেশি বেশি কোর’আন তেলা’ওয়াত কর, কেননা হাশরের দিন এ কো...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-08-15 23:24:11

হযরত মুয়াজ (রা.) রাসূল (সা.) এর কাছ থেকে কিয়ামতের দিন প্রথম তিনজন জাহা...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-02-22 00:11:13

মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আপনার উচিত সর্বদা জ্ঞান অর্জনে লিপ্ত থাকা।...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-06-29 08:34:21

"হে আল্লাহ্, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা, দুঃখ, অক্ষমতা, অলসত...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-05-06 13:46:07

হজ্জ্ব ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত। হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতিবছর জি...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-08-16 23:47:11

হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় হাদীসগ্রন্থেই...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-06-22 23:12:36

মুসলিম হওয়া যে জন্মগত কোনো ব্যাপার না, এই কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2019-02-19 23:09:08