বিজয় উদযাপন: ইসলামের শিক্ষা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা


তারেক হাসান
Published: 2024-08-06 11:39:54 BdST | Updated: 2024-09-28 07:27:17 BdST

সাধারণত বিজয়ের দুটি রূপ দেখা যায়: স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয় এবং কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়। যেখানে স্বার্থান্বেষী বিজয় ধ্বংস ও রক্তপাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে আদর্শবাদী বিজয় মানবতা ও সত্যের সেবায় নিবেদিত। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, বিজয় উদযাপনে আত্মপ্রচার ও গর্বের পরিবর্তে নম্রতা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত। মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয় এর উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে তিনি বিনা রক্তপাতেই মক্কায় প্রবেশ করে সাধারণ ক্ষমার নজির স্থাপন করেছিলেন। এই নিবন্ধে স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয় এবং তার বিপরীতে ইসলামে বিজয়ের ধারণা ও এর শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়:
এই ধরনের বিজয় যত দেশে হয়েছে, সেখানে অনেক জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে, মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন কোনো বিপ্লব ঘটেছে, তখন সেখানে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের অক্টোবরে বলশেভিক বিপ্লবের সময় জার সরকারের কুকুরটিকেও হত্যা করেছিল বলশেভিকরা। এ ছাড়া স্বার্থান্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পৃথিবীতে যখনই কোনো বিপ্লব ঘটেছে, তখন অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে বিজয় উৎসব পালন করা হয়েছে।

বিজয়ের এ রূপ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“রাজা-বাদশাহ যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তা বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাবান লোকদের অপদস্ত করে।” (সুরা: নামল, আয়াত: ৩৪)

কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়:
এই বিজয় সত্য ও আদর্শের বিজয়। মানবজাতি, মানবতা ও সভ্যতার বিজয়। মুসলিম জাতির আদর্শ ও মননে এই বিজয় সর্বজনীন ও কল্যাণকর। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সহচরদের বিজয় উদযাপনের ক্ষেত্রে বিশ্ববাসী বিজয়ের এ রূপটিই প্রত্যক্ষ করেছে। মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয় ছিল দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিপ্লব, শ্রেষ্ঠ বিজয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয় সম্পর্কে লিখেছেন,

“এ ছিল সে মহাবিজয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দ্বীন, তাঁর রাসুল (সা.)-কে তাঁর সৈন্যসম্পদকে এবং তাঁর আমানত রক্ষাকারী দলকে সম্মান দিয়েছেন এবং স্বীয় শহর ও স্বীয় ঘরকে বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, কাফির ও মুশরিকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করেছেন। এ বিজয়ে আসমানবাসীদের অন্তরেও খুশির ঢল নেমেছিল এবং তাদের মান-ইজ্জতের রশ্মিগুলো আকাশের চূড়ার কাঁধের ওপর বিস্তৃতি লাভ করেছিল, যার ফলে মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে লাগল এবং পৃথিবীর মুখমণ্ডল আলোর ঝলকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল।” (আর-রাহীকুল মুখতুম, পৃষ্ঠা ৪৫২)

মহানবী (সা.)-এর বিজয় উদযাপনে আত্মপ্রচার, বিজয়ের গৌরব ও অহংকারের কোনো চিহ্ন ছিল না। ছিল শুধু নম্রতা ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ৯ জন দাগী অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত পাঁচজনকে মাফ করে দিয়েছিলেন। এ বিজয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর এদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন।” (সুরা: হজ, আয়াত: ৪১)

ইসলামে বিজয় উদযাপনের নীতিমালা:
ইসলাম ধর্মে বিজয় উদযাপনের যে সুনির্দিষ্ট ও শাশ্বত নীতিমালা আছে, তা বাস্তবসম্মত ও কল্যাণকর। মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কা বিজয় ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। এ বিজয় উদযাপন পদ্ধতি মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয় ও নিদর্শক হতে পারে। মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেননি। বরং কৃতজ্ঞতায় তার শির নুইয়ে পড়ল মহান রবের দরবারে। তিনি বিজয়োত্তর আট রাকাত শোকরানা সালাত আদায় করলেন। প্রাণের শত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি ক্ষমা করে দিলেন। ঘোষণা করলেন শাশ্বত বিজয়বাণী:

“আজ তোমাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ নেই। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।”

বিজয় উদযাপনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা পবিত্র কোরআনুল কারিমের সুরা আন-নাসরে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং দলে দলে মানুষকে আল্লাহর দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করবেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।” (সুরা: নাসর, আয়াত: ১-৩)

বিজয় উদযাপনের শাশ্বত বিধান:
উপরোক্ত আয়াতগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বিজয় উদযাপনের শাশ্বত যে বিধান পাওয়া যায়, তা হলো:

বিজয়কে আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করা:
বিজয় মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এ নিয়ামত সব জাতি ও গোষ্ঠীর ভাগ্যে জোটে না। শুধু শক্তিমত্তা, জনবল, বাহুবল কিংবা অস্ত্রবলে বিজয় অর্জিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন স্রষ্টার ইচ্ছা ও সাহায্য।

বিজয়ের সুফল সমভাবে ভোগ করা:
সুরা নাসরের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বিন ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন।” অর্থাৎ বিজয়ের পর ইসলামের বিজয়ী শক্তির কাছে মাথানত করে অথবা ইসলামের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য মানুষরা দলে দলে ছুটে আসবে। তখন তাদের বিমুখ করা যাবে না। কিংবা তিরস্কার করা যাবে না। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুখ সবাই সমভাবে ভোগ করবে।

আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা তথা কৃতজ্ঞতা বর্ণনা করা।

সংগ্রামকালীন সংঘটিত বিচ্যুতি বা সীমা লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা:
সাংঘাত মানেই ধ্বংস বা ক্ষতি। যদিও ইসলামের বিজয় অভিযানগুলো এজাতীয় কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত ছিল, তবু আল্লাহ তাআলা অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়ে সুরা নাসরের তৃতীয় আয়াতের শেষাংশে বলেছেন:

“এবং তাঁর (আল্লাহর) কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।”

সুতরাং বিজয়ীপক্ষের উচিত যুদ্ধ বা অভিযানকালীন সংঘটিত ত্রুটি-বিচ্যুতি বা সীমা লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।

মক্কা বিজয় এবং নবীজির ‘সাধারণ ক্ষমা’: বিজয়ীদের জন্য সাধারণ শিক্ষা

মক্কা বিজয় এবং নবীজির ‘সাধারণ ক্ষমা’, বিজয়ী শাসকদের জন্য শিক্ষা এ ঘটনার পরে রাসুল (সা.) বনু খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করাতে কুরাইশদের কাছে দূত মারফত খবর পাঠান কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে এবং সন্ধি বাতিলের ঘোষণা দেয় আর বলে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৮ম হিজরির দশম রমজানে রাসুল (সা.) মক্কাভিমুখী রওনা হন, সঙ্গে ১০ হাজার মুজাহিদ সাহাবি। এখানেও নানা নাটকীয়তা শেষে কুরাইশদের ঘাড়ের ওপর এসে নিশ্বাস নিতে থাকেন, উদ্দেশ্য-মক্কা বিজয়। তিনি যথাসম্ভব রক্তপাত এড়িয়ে মক্কায় প্রবেশের কৌশল করছিলেন। ঘোষণা করলেন, কুরাইশদের যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিবে, নিজ নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখবে তারা নিরাপদ। এভাবে বলা যায় যে, মহানবী (সা.) বিনা রক্তপাতেই বিজয়ীরূপে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যুগযুগান্তরে সবার মুখে আজও যা আলোচিত হয়ে আসছে, যেই কুরাইশরা মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সামর্থের শেষ সময় পর্যন্ত অপচেষ্টা চালিয়েছিল তাদেরকে তিনি ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন, তাও যখন তিনি মক্কার অধিপতি, ইচ্ছে হলে নিয়মানুযায়ী সবাইকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারতেন। আসলে আল্লাহর রাসুলরা উত্তম চরিত্র নিয়েই দুনিয়ায় আগমন করেন, যেন উম্মত তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এর আগে একই কাজ করেছিলেন হজরত ইউসুফ (আ.)। তার ওপর ভাইদের অবিচার সত্ত্বেও তিনি যখন মিসরের সর্বোচ্চ আসনে আসীন তখন তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করেন।

“আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালুর চাইতে অধিক দয়ালু।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৯২)

দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রহরা ও বিজয়ের আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনগণের করনীয়:-

-সংখ্যা লঘুদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

-কারও ওপর কোনো আক্রমন না করা। 

-অপরাধীদেরকে আইনের হাতে সোপর্দ করা এবং আইনী প্রক্রিয়ায় তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা। 

-পাড়া মহল্লায় এমনভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যেন কেউ কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে পারে।

-কোনো রকম বিদেশী ফাঁদে পা না দেয়া ।

-কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি না করা। একজন প্রকৃত মুসলিম কখনোই দেশের সম্পদের ক্ষতি করতে পারে না, সংখ্যা লঘুদের বাড়িতে আক্রমণ করতে পারেনা।

যে কোন বিজয়ের মতই এ বিজয়ের পেছনেও ছিল মহান আল্লাহর সাহায্য; আলহামদুলিল্লাহ সেই কারণেই ছাত্র ও জনতা পেয়েছে নতুন স্বাধীনতা ও বিজয়। সুতরাং মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহিদের আত্মার সর্বোচ্চ মযাদা  প্রার্থনা করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। মুসলিমদের উচিত ইসলামি সংস্কৃতি অনুসরণের মাধ্যমে বিজয় দিবস উদযাপন করা। বিজয় দিবসে সব শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা শৃংখলা রক্ষায় একাত্মতা প্রকাশ করে দেশকে বিশৃংখলা মুক্ত রেখে একটি দূর্নীতি ও শোষণমুক্ত ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট প্রতিষ্ঠা হোক প্রতিটি নাগরিকের দৃপ্ত শপথ। 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


ইসলামী বিষয়াবলী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে সজীব, তাদের কর্মের কারণে সন্তুষ্ট, তারা থাকবে...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-04-23 23:36:39

রাসূল স. বলেছেনঃ বেশি বেশি কোর’আন তেলা’ওয়াত কর, কেননা হাশরের দিন এ কো...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-08-15 23:24:11

হযরত মুয়াজ (রা.) রাসূল (সা.) এর কাছ থেকে কিয়ামতের দিন প্রথম তিনজন জাহা...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-02-22 00:11:13

মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আপনার উচিত সর্বদা জ্ঞান অর্জনে লিপ্ত থাকা।...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-06-29 08:34:21

"হে আল্লাহ্, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা, দুঃখ, অক্ষমতা, অলসত...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-05-06 13:46:07

হজ্জ্ব ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত। হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতিবছর জি...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-08-16 23:47:11

হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় হাদীসগ্রন্থেই...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2018-06-22 23:12:36

মুসলিম হওয়া যে জন্মগত কোনো ব্যাপার না, এই কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ...

ইসলামী বিষয়াবলী | 2019-02-19 23:09:08