কথার জাদুকর মির্জা গালিব


সিরাজুম মুহসিনা সিলভিয়া
Published: 2019-02-15 23:46:59 BdST | Updated: 2024-04-29 09:22:25 BdST

ছবিঃ ইন্টারনেট

ভাবুন তো... আপনার খুব কাছের কোনো বন্ধু আপনার বাসার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গেল। কিন্তু আপনার সাথে দেখা করে গেল না। এমন হলে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? সে যাই হোক... এমনটাই ঘটেছিল কবি মির্জা গালিবের সাথে। তার বন্ধু ও ভক্ত দিউয়ান ফজলুল্লাহ খাঁ তার বাসার পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করেছেন জেনে মির্জা গালিব খুবই কষ্ট পান। তখন তিনি একটি চিঠি দিলেন দেউয়ানজিকে। সে চিঠি পেয়ে সাথে সাথেই লজ্জিত দেউয়ানজি চলে গিয়েছিলেন মির্জা গালিবের বাড়িতে। সে চিঠিটিতে কী ছিল? দেখেই নিনঃ   

“আজ আমার এতো অনুতাপ হলো যে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশী অযোগ্যতা আমার আর কি হতে পারে যে আপনি আমার বাসার পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করলেন, কিন্তু আমি আপনাকে একবারও সেলাম জানাতে পথে হাজির হতে পারিনি । কি বদ নসিব আমার।”

 

বর্তমানে কথার জাদুকর মির্জা গালিবের এ ধরণের রসিকতা, গজল, কবিতা ও উক্তির অসংখ্য উদাহরণ প্রচলিত আছে। মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের প্রকৃত নাম ছিল আসাদুল্লাহ বেগ খান। ১৭৯৭ সালে তিনি আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র নয় বছর বয়স থেকে মির্জা গালিব কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। ফারসি ভাষাকে তিনি তার প্রথম প্রেম হিসেবে অভিহিত করতেন। নিজের লেখনী নিয়ে তার মনে ছিল আত্মবিশ্বাস এবং তীব্র অহংকার। তিনি নিজের কাব্য প্রতিভা নিয়ে লিখেছেনঃ

"আমার হৃদয়ের আগুন থেকেই আলো দিচ্ছে আমার কবিতা, আমি যা লিখছি তাতে একটি আঙ্গুল দেয়ার সাধ্য নেই কারো৷"

 

তবে সে সময় মির্জা গালিবের সমালোচকদের সংখ্যাও খুব কম ছিল না। অনেকেই তার কবিতা বুঝতে না পেরে তাকে ‘পোয়েট অব ননসেন্স’ বা ‘প্রলাপ বকিয়ে’ নামে সম্বোধন করতো। কবি তাদেরকে নিয়ে লেখেনঃ

‘ইয়া রব, ও না সামঝে হ্যায় না সামঝেংগি মেরি বাত
দে অর দিল উনকো জো না দে মুঝকো জবান অর।’

অর্থাৎ, ‘হে খোদা, সে না বুঝতে পারে আমাকে, না বুঝতে পারে আমার কথা
তাকে দাও ভিন্ন হৃদয়, অথবা আমাকে দাও ভিন্ন বাচনভঙ্গি।’

 

মির্জা গালিব তের বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। নওয়াব ইলাহী বখশ খানের কন্যা ওমরাও বেগমকে বিয়ে করার পর তিনি আগ্রা থেকে দিল্লীতে যেয়ে বসবাস করা শুরু করেন। তিনি চাদনী চকের কাছে একটি প্রাসাদ ভাড়া করেছিলেন। তিনি সাত সন্তানের পিতা হলেও তারা কেউই বেশীদিন বেঁচে ছিল না। এ নিয়ে তার মনে প্রবল দুঃখবোধ ছিল। তিনি লেখেনঃ

‘দিল হি তো হ্যায়, না সংগ ও খিস্ত, দর্দসে ভর না আয়ে কিউ
রোয়েংগে হাম হাজার বার, কোই হামেঁ সাতায়ে কিউ।’

অর্থাৎ, ‘এটাতো আমার মন, ইট পাথরতো নয়, বেদনায় ভরবে না কেন?
আমি কাঁদবো হাজারবার, কেউ আমায় উত্যক্ত করে (কাঁদায়) কেন?

 

আত্মবিশ্বাসী কবি মির্জা গালিব ভাগ্য নিয়ে লেখেনঃ

হে-গালিব কভু
ভাগ্য দেখো না
হাতের তালুর রেখায়!
চেয়ে দেখো বহু
হাতহীন সুখী
নিত্য তোমাকে শেখায়! 

মদ, জুয়া এবং নারীর প্রতি মির্জা গালিবের তীব্র আসক্তি ছিল। লাল কেল্লার পতনের পর তিনি ইংরেজদের কাছে বন্দি হন। এ সময় কর্নেল ব্রাউন মির্জা গালিব মুসলিম কিনা জিজ্ঞাসা করলে মৃত্যুমুখেও তিনি রসিকতা করে উত্তর দেন, "মুসলিম কিন্তু আধা"। কর্নেল ব্রাউন এ উত্তরে অবাক হলে তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, "শরাব পীতা হু, লেকিন শুকর নেহী খাতা’ অর্থাৎ মদ পান করি, কিন্তু শুকর খাইনা।) গালিবের এ রসিকতা শুনে কর্নেল ব্রাউন তাকে মুক্তি দিয়ে দেন।  

মির্জা গালিব দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আগ্রায় বসবাস করেছেন। শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় বসবাস করলেও তিনি কখনো আভিজাত্যপূর্ণ জীবন যাপন করেননি। তিনি এতটাই সরল জীবন যাপন করতেন যে, তিনি প্রচুর বই পড়তেন কিন্তু কখনো বই কিনেননি। বরং ধার করে বই পড়তেন। মোঘল সম্রাট তাকে ‘দাবির-উল-মূলক’ ও ‘নজম-উদ-দৌলা’ খেতাব প্রদান করেছিলেন। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে মির্জা গালিবকে ভয়াবহ আর্থিক দৈন্যদশায় জীবন কাটাতে হয়।

১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মির্জা গালিব মৃত্যু বরণ করেন। তার সমাধিস্থলে শ্বেতপাথরের ওপর লেখা আছে তারই লেখা কবিতার চার চরণঃ 

সাড়ে তিন হাত জমি-ই ছিল যে
গালিবের নজরানা,
মৃত্যুর শেষে পেলে অবশেষে
জমিটির মালিকানা!

মির্জা গালিব যে বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেছেন তা ইনডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর) এবং ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে গালিব মেমোরিয়াল বা গালিব কি হাভেলি নামে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। gocityguides.com থেকে সংগৃহীত গালিব কি হাভেলির কিছু চিত্র দেয়া হলোঃ 

   

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম ব্যক্তিত্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


(জন্মঃ ৮১০-মৃত্যুঃ ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ), আরব রীতি অনুযায়ী বংশধারাসহ পুরো...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-22 11:55:49

ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই ভারতের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। বা...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-04-08 09:16:03

ইবনে রুশদ ছিলেন আধুনিক সার্জারির জনক। সেই সাথে ছিলেন একজন বড় মাপের আধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-01 00:44:18

সাহাবী  হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলতেন- আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং নাম...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2020-02-06 18:38:47

ভাবুন তো... আপনার খুব কাছের কোনো বন্ধু আপনার বাসার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গে...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2019-02-15 23:46:59

সংখ্যার জগতে ‘শূণ্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গণিতের প্রাথমিক ১-৯ সংখ্...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-13 13:42:39

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-10-28 14:09:44

অনেকদিন আগে, দামিশকের একজন পিতা তার পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতে বের হয়েছিল...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-01 20:15:53