আন্দালুসিয়ার ৬ জন বিজ্ঞানী যাদের সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার


আফিফা থাবেত
Published: 2023-11-10 19:19:04 BdST | Updated: 2024-04-29 04:19:01 BdST

যখন আমরা আন্দালুসিয়া বা অতীত স্পেন সম্পর্কে কথা বলি, তখন আমরা প্রায়শই ইসলামের স্বর্ণযুগ, ইসলামী সভ্যতার গৌরব এবং কীভাবে আন্দালুসিয়া প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি ছিল তা নিয়ে ভাবি।   

জ্ঞানই শক্তি, আর জ্ঞানের অন্বেষন করা ইসলামে একটি বাধ্যবাধকতামূলক কাজ বা ফরজ। জ্ঞান ছাড়া কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়, এবং প্রথমদিকের মুসলিমরা সেটাই করেছিল, তা আন্দালুসিয়াতে হোক বা চীনে। আন্দালুসিয়ান মুসলিম পুরুষ ও মহিলা বিজ্ঞানীগণ আটশত বছর ধরে মানবতার বিবেক ও চেতনাকে আলোকিত করার জন্য তাঁদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ইবনে রুশদ, আল-জাহরাভি, ইবনে যুহর, ইবনে তুফায়েল, আব্বাস ইবনে ফিরনাস, ইবনে বাজ্জাহ। এছাড়াও আরও অনেক আন্দালুসিয়ান মুসলিম বিজ্ঞানী বিশ্বকে আলোকিত ও জয় করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য কয়েকজন আন্দালুসিয়ান বিজ্ঞানী যারা কম পরিচিত, তাদের সম্পর্কেও আমাদের জানা উচিত যারা তাদের অবদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।

এখানে সেরকম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৬ জন আন্দালুসিয়ান বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ দেওয়া হল:

১. আবু বকর মুহাম্মদ ইবনুল ওয়ালিদ আত-তুরতুশি

টরটসায় জন্মগ্রহণকারী আত-তুরতুশি ছিলেন দ্বাদশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত আন্দালুসিয়ান রাজনৈতিক দার্শনিকদের একজন। তাঁর বই "কিতাব সিরাজুল মুলুক" (রাজাদের প্রদীপ) রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে রচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের মধ্যে একটি।

২. আলী ইবনে হাজম আল-আন্দালুসী

ইবনে হাজম ছিলেন একাদশ শতকের একজন আন্দালুসিয়ান মুসলিম পন্ডিত, কবি, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, বংশতালিকাবিদ, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং কর্ডোবা থেকে আরবি, হিব্রু এবং সিরিয়ান ভাষাবিদ।

তিনি যুক্তি বিদ্যা এবং শব্দ ও শব্দের গতিবেগের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক বই লিখেছিলেন। তিনি কর্ডোবার মসজিদে শব্দের প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে এটিকে চিত্রিত করেছেন এবং বজ্রপাত ও  বজ্রপাতের মধ্যবর্তী সময়ের উল্লেখ করেছেন। ইবনে হাজম কোরআন, বাইবেল এবং তাওরাত অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি অনেক মুসলিম পণ্ডিত, খ্রিস্টান যাজক এবং ইহুদি রাব্বিদের সাথে বিতর্ক করেছিলেন। আমরা এখন যাকে "তুলনামূলক ধর্ম অধ্যয়ন" বলি এই বিষয়ের জনক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। 

ইবনে হাজম গ্যালিলিওর ৫০০ বছর আগে নিশ্চিত করেছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং তাঁর গবেষণাকে কোরআনের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন। তিনি কর্ডোবায় উমাইয়া রাজবংশের অধীনে কিছু সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সর্বোত্তম সংরক্ষিত গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি হল "Ring of the Dove"। এই বই ভালোবাসা এবং প্রিয়জন সম্পর্কে দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি সম্পর্কিত। মধ্যযুগীয় ইউরোপ এই গ্রন্থটি থেকে অনেক কিছু শিখেছে এবং এটি এখনও সেরা ও জনপ্রিয় গ্রন্থসমূহের মধ্যে একটি হিসাবে পরিচিত যেটি "ভালোবাসা" এবং "প্রিয়জন" উভয় ধারণাকে বিশুদ্ধ উপায়ে আলোচনা করে।

৩. ইবনে রাজিন আল-তুজিবী

আল-তুজিবী ছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন আন্দালুসিয়ান পণ্ডিত, আইনজীবী, কবি এবং বিশেষ করে মুরসিয়ার একজন খুব বিখ্যাত গ্যাস্ট্রোনম বিশেষজ্ঞ। তিনি বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ লিখেছেন, কিন্তু তাঁর রান্না বিষয়ক বই The Delights of the Table and the Best Types of Prepared Foods ছাড়া তাঁর আর কোন গ্রন্থ বর্তমানে অবশিষ্ট নেই। আন্দালুসিয়ান ও উত্তর-আফ্রিকান রান্না এবং ভেষজ ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর লেখার পাশাপাশি, তিনি উপযুক্ত রান্নার পাত্র (তাদের সুবিধা এবং অসুবিধা) ব্যবহার সম্পর্কেও লিখেছেন এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য তাদের সুবিধার উপর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা সহ বর্ণানুক্রমিকভাবে ভেষজ এবং রেসিপির নাম সাজিয়েছেন। তাঁর বই জনপ্রিয় না হওয়া পর্যন্ত কিছু ভেষজ ইউরোপে পরিচিত ছিলই না।

৪. আবুল হাসান ইবনে আলী আল-কালাসাদী

আবুল-হাসান ইবনে আলী আল-কালাসাদি ছিলেন গ্রানাডার নিকটবর্তী অঞ্চল বাজা এর অধিবাসী পঞ্চদশ শতকের একজন আন্দালুসিয়ান গণিতবিদ, দার্শনিক, চিকিত্সক এবং ইসলামী পন্ডিত। তিনি মালেকি মাজহাবের একজন সুপরিচিত ফকিহ ছিলেন। তিনি standard algebraic symbols এর প্রতিষ্ঠাতা যা আমরা আজ বীজগণিতে ব্যবহার করি। তিনি প্রাচীনকাল থেকে algebraic notation এ সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এবং তিনিই algebraic symbolism এর প্রবর্তনের জন্য প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি আরবি বর্ণমালার অক্ষর ব্যবহার করে গাণিতিক চিহ্নের প্রতিনিধিত্বমূলক চিহ্ন তৈরী করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি গণিতে "x" ব্যবহারের সূচনা করেন। 

তিনি একটি গ্রন্থও লিখেছেন যাতে তিনি আরবি কবিতায় বীজগণিতের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর গবেষণা ও গ্রন্থ ইউরোপীয় গণিতবিদদের উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল এবং গণিতের জগতে বৈজ্ঞানিক বিবর্তন ও বিপ্লব ঘটিয়েছিল।

৫. লুবনা আল-কুরতোবিয়া

লুবনা আল-কুরতোবিয়া দশম শতাব্দীর একজন আন্দালুসিয়ান মহিলা বিজ্ঞানী এবং তিনি কর্ডোবায় খলিফার সচিব ছিলেন। তিনি উভয় খলিফার (আব্দুর রহমান তৃতীয় এবং পরবর্তীতে তাঁর পুত্র আল-হাকাম দ্বিতীয়) এর প্রাসাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিজীবী মহিলা ছিলেন যিনি আরবি কবিতা, ব্যাকরণ, আরবি ক্যালিগ্রাফি শিল্প এবং গণিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বই এবং পাণ্ডুলিপি আরবিতে অনুবাদ করেছেন। তিনি মদিনা আজ-জাহরার বিখ্যাত গ্রন্থাগার তৈরির পিছনে চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং খলিফাগন কর্ডোবায় লাইব্রেরির দায়িত্বে তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন।

৬. মাসলামা আল-মাজরিতি এবং তাঁর কন্যা ফাতিমা আল-মাজরিতিয়া

মাসলামা আল-মাজরিতি ছিলেন দশম শতকের একজন আন্দালুসিয়ান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, রসায়নবিদ এবং আন্দালুসিয়ার অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধের লেখক। তাঁকে "আন্দালুসিয়ার গণিতবিদদের ইমাম" বলে ডাকা হত। তিনি টলেমির "আলমাজেস্ট" গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন। তিনি scientific exchange and the emergence of networks for scientific communication এর একটি ভবিষ্যত প্রক্রিয়ার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

তিনি জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের একটি স্কুল তৈরি করেছিলেন এবং আন্দালুসিয়ায় সংগঠিতভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনা করেছিলেন। তিনি আল-খারিজমির জ্যোতির্বিদ্যা সারণী প্রবর্তন ও উন্নতি করেন এবং পারস্য ক্যালেন্ডারকে ইসলামী ক্যালেন্ডার বা হিজরী ব্যবস্থায় রূপান্তর করে তাঁর কন্যা ফাতিমার সহযোগী ঐতিহাসিকদের সাহায্য করেন।

ইসলামিক ক্যালেন্ডার ব্যবস্থার প্রবর্তনের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে এবং যেভাবে তিনি এটি গণনা করেছিলেন তাতে কর্ডোবা বিশ্বের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তিনি নতুন অনুসন্ধানী কৌশল এবং triangulation চালু করেছিলেন। 

তাঁর কন্যা ফাতিমা জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান রেখেছিলেন। তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাব কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বই লিখেছেন। মাসলামা এবং ফাতিমা (পিতা ও কন্যা) সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহের অবস্থান গণনা করা, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঘটনা সমূহ সংকলন ও বিন্যস্ত করে একটি ক্যালেন্ডার তৈরী করা এবং সূর্যাস্ত এবং চন্দ্রগ্রহণ গণনা গবেষণার ক্ষেত্রে একসাথে কাজ করেছিলেন। 

সূত্র : এবাউট ইসলাম

অনুবাদ: তারেক হাসান।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম ব্যক্তিত্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


(জন্মঃ ৮১০-মৃত্যুঃ ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ), আরব রীতি অনুযায়ী বংশধারাসহ পুরো...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-22 11:55:49

ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই ভারতের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। বা...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-04-08 09:16:03

ইবনে রুশদ ছিলেন আধুনিক সার্জারির জনক। সেই সাথে ছিলেন একজন বড় মাপের আধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-01 00:44:18

সাহাবী  হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলতেন- আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং নাম...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2020-02-06 18:38:47

ভাবুন তো... আপনার খুব কাছের কোনো বন্ধু আপনার বাসার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গে...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2019-02-15 23:46:59

সংখ্যার জগতে ‘শূণ্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গণিতের প্রাথমিক ১-৯ সংখ্...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-13 13:42:39

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-10-28 14:09:44

অনেকদিন আগে, দামিশকের একজন পিতা তার পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতে বের হয়েছিল...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-01 20:15:53