মার্টিন লিংস : ফাহমিদ-উর-রহমান


ফাহমিদ-উর-রহমান
Published: 2023-02-28 21:16:36 BdST | Updated: 2024-04-29 04:50:53 BdST

মার্টিন লিংসকে নিয়ে মুসলিম দুনিয়ার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক ধরনের সংবেদনা আছে। এই সংবেদনা তৈরি হয়েছে মূলতঃ তার কৃত রসুল (স.)-এর অসাধারণ জীবন চরিতটির জন্য। বইটির পুরা নাম হচ্ছে Muhammad His life based on the earliest sources ইউরোপে সেই মধ্যযুগ থেকে রসুল (স.)-এর উপর লেখালেখি চলছে। সে সব লেখার অধিকাংশই রসুল (স.)-এর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন বলে খ্যাতি অর্জন করেছে। তারপর মধ্যযুগ পার হয়ে ওরিয়েন্টালিস্টদের যুগেও তাঁকে নিয়ে বিপুল সাহিত্য রচিত হয়। আসল কথা হচ্ছে এর কোনটি কিন্তু নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য জীবনচরিত হিসেবে যথার্থতার দাবি করতে পারেনি। কোন জীবন চরিতই বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থান পায়নি। ইংরেজি ভাষায় লিংস সেই দীর্ঘদিনের অভাব পূরণ করেছেন।

এ বই লেখার সাথে সাথে মুসলিম মনীষার জগতে লিংসের স্থান নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এ বইতে একদিকে রয়েছে তার গভীর পান্ডিত্যের ছাপ, ঐতিহাসিকতার প্রতি সম্ভ্ৰমৰোধ আর রসুল প্রেমের তুলনাহীন নিদর্শন। এ বই হচ্ছে পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের অপূর্ব সমন্বয়। লিংসের বর্ণনাশৈলী চমৎকার। এর মধ্যে এক ধরনের জাদু আছে যা পাঠককে চুম্বকের মত টানে। একবার পড়তে বসলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বই থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। এ বই পড়তে পড়তে পাঠক যেন লিংসের হাত ধরে স্থান কাল অতিক্রম করে সেই ১৪০০ বছর আগেকার মক্কা মদীনায় পরিভ্রমণ করে আসেন যেখানে রসুল তার ঐশী মিশন নিয়ে কাজ করে গেছেন। লিংস তার পাঠককে এক ধরনের সম্মোহনের মধ্যে ইসলামের সেই প্রথম ২৩ বছরের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ ও উত্তেজনার আবহে নিয়ে যান। যেখানে পাঠক পুরনো অতীতকে চোখের সামনে জীবন্ত দেখতে পায়। পাঠককে ধরে রাখার এই অপূর্ব শক্তি একজন লেখকের জন্য অবশ্যই বড় গুণ।

এ ধরনের একটি বই একদিনে তৈরি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন লেখকের দীর্ঘ মানস প্রস্তুতি ও লেখাপড়ার পটভূমি। লিংস ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। দীর্ঘকাল তিনি ছাত্রদের শেক্সপিয়ার পড়িয়ে কাটিয়েছেন। বোঝাই যায় ইংরেজি ভাষার উপর তার ছিল প্রগাঢ় অধিকার। ভাষার উপর যথেষ্ট অধিকার না থাকলে কখনোই এত প্রাঞ্জল, এত অনবদ্য সাহিত্যিক গদ্যে তিনি এ বই
লিখতে পারতেন না। একই সাথে লিংসের ছিল আরবী ভাষা ও সাহিত্যের উপর সমান অধিকার এবং আরবী
লোকজীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচিতি। দীর্ঘকাল ধরে তিনি আরবীয়দের সাথে কাটিয়েছেন । আরবী সংস্কৃতির সাথে তার এই নিবিড় পরিচয় তাকে সবরকমের সংস্কার অতিক্রম করে রসূল চরিত্রকে বুঝতে অনুপ্রাণিত করেছে। এ বোঝাবুঝিই তাকে সংস্কার মুক্তভাবে রসুল চরিত লিখতে সাহায্য করেছে যা ইউরোপের অন্যান্য চরিতকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি। লিংসের এ বই নির্ভরযোগ্য হওয়ার আরও একটা কারণ আছে। দীর্ঘকাল ধরে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রাচ্যদেশীয় প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংরক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। এ দায়িত্বে থাকাকালে নিজের হেফাজতে থাকা দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপিগুলোর তিনি যথাসাধ্য। সদ্ধ্যবহার করেন। এ কারণেই তার লেখা রসুল চরিত গতানুগতিক বর্ণনা না হয়ে সম্পূর্ণ প্রাথমিক সূত্র থেকে তথ্যপঞ্জী আহরণ করে এক অনবদ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে অবিসংবাদী স্বীকৃতি অর্জন করে। অগণিত ইংরেজি ভাষী পাঠকের কাছে এ বই দ্রুত বেষ্টসেলারের মর্যাদা পায়।

মার্টিন লিংসের জন্ম বৃটেনের ল্যাংকাশায়ারের বুর্নেগিতে, জানুয়ারি ১৯০৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে। তার শৈশবের পুরোটাই কেটে যায় পিতার সাথে তার কর্মস্থল যুক্তরাষ্ট্রে। পরে বৃটেনে ফিরে এসে তিনি বৃষ্টলের ক্লিফটন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি ইংরেজিতে বি এ পরে এম এ ডিগ্রি নেন। কিন্তু তরুণ লিংসের জন্য স্বভূমি বৃটেন কোন স্থায়ী আকর্ষণের হাতছানি দেয় না। তার অনেক পূর্বসূরী বুদ্ধিজীবী, অভিযাত্রী ও সাংবাদিকের মতো তিনি প্রাচ্যের রহস্যঘেরা' জীবনের টানে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি যান লিথুয়ানিয়ায়। কিছুদিন সেখানকার কাউনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বন্ধুর আমন্ত্রণে মিসর এসে হাজির হন। এই মিশরই লিংসের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই সফরের সময় তার বন্ধু এক দুর্ঘটনায় মারা যান এবং বন্ধুর ইংরেজির লেকচারার পদটি গ্রহণ করার জন্য কাকতালীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে অনুরোধ করে। এইভাবে মিসরের সাথে তার বন্ধন তৈরি হয়। মিসর তার জন্য ভবিষ্যতের এক নতুন দরজা খুলে দেয়। তিনি মিসরের ঐশ্বর্যের ধুলোবালিতে গড়াগড়ি দেন। কায়রোতে তার পরিচয় হয় বিখ্যাত ফরাসী অতীন্দ্রিয়বাদী সুফী দার্শনিক রঁনি গেনঁ (Rene Guenon) এর সাথে। ইসলামের সুফী সাধনার ধারা রঁনি গেনেঁর হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল। সেই আলোড়নের প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং ১৯৩০ সাল থেকে কায়রোতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি সাধিলিয়া সুফী তরীকার অনুসারী হন । তার নতুন নাম হয় আবদুল ওয়াহিদ ইয়াহিয়া। গেনঁ একটি বিশেষ দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন যা Traditionalist Philosophy বা সনাতনী চিন্তাধারা নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। এ চিন্তাকে বলা যায় আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনজাত চূড়ান্ত ভোগবাদ ও বস্তুবাদ সর্বস্ব জীবনের বিরুদ্ধে একটা বড় প্রতিবাদ। গেনেঁর চিন্তার মূলকথা ছিল ঐশী জ্ঞান হচ্ছে সময় নিরপেক্ষ। সময়ের জীর্ণতা অতিক্রম করে ঐশী জ্ঞান এক চিরন্তন জগতের আস্বাদ দেয় আমাদের। এই ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞানই মানুষকে বস্তুবাদী দর্শনের উপজাত যুদ্ধ, মহামারী, সন্ত্রাস প্রভৃতি অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে।

সেদিক দিয়ে গেনঁ ইউরোপীয় রেনেসাঁ উদ্ভূত যে দর্শন, তার ধারণা এক প্রকার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে করেন শুধু মানুষের বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা বস্তুগত সমৃদ্ধি এই পৃথিবীর মানুষের বহু আরাধ্য শান্তি আনতে পারে না। যদি সেটা সম্ভব হতো তাহলে আধুনিককালেই আমরা তা দেখতে পেতাম। কারণ একালের মতো বস্তুগত সমৃদ্ধ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর কখনো হয়নি।

মিসরের বছরগুলোতে মার্টিন লিংস এই রঁনি গেনেঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। বলা চলে গেনেঁর বুদ্ধিবৃত্তি ও দার্শনিকতার প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে লিংস ইসলাম কবুল করেন। লিংসের নতুন নাম হয় আবুবকর সিরাজ আদ-দীন। তার ইসলাম কবুলের সনটি ছিল ১৯৩৮। গুরুর মত লিংসও সাধিলিয়া তরীকায় যুক্ত হন। এই তরীকায় তার বিশ্বাস আমৃত্যু অটুট ছিল। সুফী তরীকার সাধনায় তিনি অনেক উপরে উঠে আসেন এবং নিজের যোগ্যতা ও অধ্যবসায়ের গুনে একপর্যায়ে
সুফী জগতে তিনি শেখ বা Spiritual Guide হিসেবে পরিগণিত হন।

গেনেঁর ইন্তেকালের (১৯৫১) পর লিংস তার প্রাক্তন গুরুর সমসাময়িক জার্মান সুফী দার্শনিক থ্যুসফ স্যুনের (Fritjof Schuon) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। স্যুনও গেনেঁর সমসাময়িক কালেই ইসলাম কবুল করেন। তাসাউফ জগতে স্যুনের গুরু ছিলেন আলজেরিয়ার সূফী শেখ আহমদ আল আলাবী। এই আলাবীর জীবন ও চিন্তাধারা হয় লিংসের পরবর্তী সময়ে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয়বস্তু।

পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও ভোগবাদ প্রধান সমাজে সনাতনী চিন্তাধারা এখন আর কোন ভুঁইফোঁড় বিষয় নয়। ভোগবাদের অভিশাপ থেকে বাঁচবার জন্য সেখানকার অনেক মানুষই আজ সনাতনী চিন্তাধারার অনুসারী হয়ে উঠেছেন। সুফীতত্ত্বের মূল থা হচ্ছে প্রেম। এর মধ্যে কোন স্বার্থপরতা নেই। অন্যের অধিকার অস্বীকারেরও সুযোগ নেই। সুফী পরিভাষায় একেই বলা হয় সুলহি কুল সকলের জন্য শান্তি। সনাতনী চিন্তাধারার অনুসারীরা ইসলামী সুফীতত্ত্বের এই সর্বজনীনতা দিয়ে আজকের দুনিয়ার অসংগতি, বিপর্যয় ও হানাহানির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান।

সুফী সাধনমার্গে পৌছানোর সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে হযরত রসুল (স.)-এর আদর্শের নৈকট্য অনুভব করা। কারণ সুফীরা মনে করেন রসুল (স.) হচ্ছেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম  সুফী। সুতরাং তার দেখানো পথেই সুফী সাধনায় যথার্থ সাফল্য আসতে পারে। মার্টিন লিংস হয়তো এই প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সুফীর জীবনচরিত লিখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। পাশ্চাত্য জগতে এখন সনাতনী চিন্তাধারার বড় প্রবক্তা হচ্ছেন Islam and the Destiny of Man এর সুবিখ্যাত লেখক চার্লস লা গায় ইটন (Charles La Gai Eaton) এবং ইরানী বুদ্ধিজীবী সৈয়দ হোসাইন নসর।

সনাতনপন্থীরা শুধু বস্তুবাদী ও প্রগতিমূলক দর্শনের সমালোচনা করেননি। তারা এই দর্শনজাত আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ব্যাপারেও সন্দেহবাদী। তারা মনে করেন জনগণের নেতৃত্ব থাকা উচিত ধার্মিক লোকের হাতে। কারণ তারাই সমাজকে অবক্ষয় থেকে দূরে রাখতে পারে। এই ধরনের ধার্মিক নেতৃত্বাধীন শাসন ব্যবস্থার ধারণা নতুন নয়। মুসলিম জগতের অনেক দার্শনিকই এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার কথা বিভিন্ন সময় আমাদের বলেছেন এবং এদের ধারণামতে এটি হচ্ছে উত্তম শাসন ব্যবস্থা । মার্টিন লিংস ছিলেন এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার উৎসাহী সমর্থক। এ ব্যবস্থাকে তিনি বলেছেন : principled Autocracy. সনাতনপন্থীদের ধারণা হচ্ছে অতীতের ব্যবস্থাগুলোই ছিল আদর্শমূলক ও বিশুদ্ধবাদী। যেমন রসুলের যুগটা হচ্ছে মুসলমানদের কাছে মডেল। এ প্রণঙ্গে লিংসের ভাষ্য শোনা যাকঃ
The initial Islamic community in Mecca and Medina at the time of the Prophet, in its outward aspects, was the perfection of primordial simplicity: (চলবে)

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম ব্যক্তিত্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


(জন্মঃ ৮১০-মৃত্যুঃ ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ), আরব রীতি অনুযায়ী বংশধারাসহ পুরো...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-22 11:55:49

ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই ভারতের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। বা...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-04-08 09:16:03

ইবনে রুশদ ছিলেন আধুনিক সার্জারির জনক। সেই সাথে ছিলেন একজন বড় মাপের আধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-01 00:44:18

সাহাবী  হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলতেন- আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং নাম...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2020-02-06 18:38:47

ভাবুন তো... আপনার খুব কাছের কোনো বন্ধু আপনার বাসার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গে...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2019-02-15 23:46:59

সংখ্যার জগতে ‘শূণ্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গণিতের প্রাথমিক ১-৯ সংখ্...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-13 13:42:39

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-10-28 14:09:44

অনেকদিন আগে, দামিশকের একজন পিতা তার পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতে বের হয়েছিল...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-01 20:15:53