আমর ইবনুল আস (রা)


ইসলামী বার্তা ডেস্ক
Published: 2020-01-05 19:20:55 BdST | Updated: 2024-05-16 20:01:51 BdST

আমর ইবনুল আস (রা) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে রাসূল (স)-এর চরম শত্রুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি এমন ব্যক্তিদের মাঝে একজন ছিলেন যার আচরণের কারণে রাসূল (স.) আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে দুয়া করেছিলেন। রাসূল (স.) এ দুয়া করার পর আল্লাহ তা’আলা তাদের ওপর এ ধরণের দুয়া করতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। মুসলিম হওয়ার পরবর্তী অবদানের কারণে আমর ইবনুল আস (রা) ইসলামের মহা সেনা নায়ক, আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ র্ধূত কূটনীতিক, মিসরবাসীর মুক্তির মাধ্যম হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন।

ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আল্লাহর রাস্তায় তিনি প্রশস্ত চিত্তে ব্যয় করেছেন। আমর ইবনুল আস (রা)-এর দানের কারণে রাসূল (স.) তার জন্য দুয়া করতেন। আলকামা ইবন রামসা বালাবী বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) এক বাহিনী সহ আমরকে পাঠালেন বাহরাইন এবং নিজে বের হলেন অন্য এক অভিযানে। আমিও রাসূলুল্লাহর (সা) এ অভিযানে সহযাত্রী ছিলাম। একদিন রাসূল (সা) একটু তন্দ্রালু হলেন। তন্দ্রা কেটে গেলে বললেন, ‘আল্লাহ আমরের ওপর রহম কর।’ আমাদের মধ্যে যারা এ নামের ছিল, আমরা প্রত্যেকেই তাদের কথা চিন্তা করলাম। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার তন্দ্রাভিভূত হলেন এবং জেগে উঠে একই একই কথা বললেন। আমাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোন আমরের কথা বলছেন?’ বললেনঃ

আমর ইবনুল আস। আমরা কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেনঃ আমার সেই সময়ের কথা স্মরণ হয়ে গেল যখন আমি মানুষের কাছে সাদাকাহ বা দান চেয়েছি, সে প্রচুর সাদাকাহ নিয়ে এসেছে। যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছি, এত সাদাকাহ কোথা থেকে নিয়ে এসেছো? সে বলেছে, আল্লাহ দিয়েছেন। অন্য একবার রাসূল (সা) তিনবার বলেন, “হে আল্লাহ, তুমি আমর ইবনুল আসকে ক্ষমা করে দাও। যখন আমি তাকে সাদাকাহ দেয়ার জন্য বলেছি, সে সাদাকাহ নিয়ে হাজির হয়েছে।”

 

আমর ইবনুল আস (রা) এর জন্মও শৈশবকাল সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি  মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনু সাহম নামক এক সম্ভ্রান্ত গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মুসলমানদের যে প্রথম দলটি হাবশায় যায়, তার সবচেয়ে উৎসাহী সদস্য ছিলেন আমর ইবনুল আস। তিনি হাবশায় রাজা ও রাজদরবারে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলেন এবং মুসলমানদের হাবশা থেকে বহিষ্কারের ব্যাপারে তাদেরকে স্বমতে আনার সব রকম চেষ্টা চালান। বাদশাহর দরবারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মত্যাগের অভিযোগ উত্থাপন করে জ্বালাময়ী ভাষণও দেন। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

 

খন্দকের যুদ্ধের পর আমর ইবনুল আস (রা) অনুধাবন করেন বিজয়ী হওয়ার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে।  এ সময়ে তার চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলে বলেছেন,

“এই চিন্তা-ভাবনার ফলে ইসলামের মূলকথা ধীরে ধীরে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। আস্তে আস্তে আমি মুসলমানদের বিরোধিতা থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম। কুরাইশ নেতারা তা বুঝতে পেরে আমার কাছে একজন লোক পাঠালো। সে আমার সাথে তর্ক শুরু করলো। আমি তাকে বললাম, ‘বলতো, সত্যের ওপর আমরা, না পারসিক ও রোমানরা?’ সে বললো, ‘আমরা’, জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুখ-সম্পদ ও ঐশ্বর্যের অধিকারী তারা, না আমরা?’ সে বললো, তারা। আমি বললাম, ‘এ জীবনের পরে যদি আর কোন জীবন না থাকে তাহলে আমাদের এ সত্যাশ্রয়ী জীবন কী কাজে আসবে? এ দুনিয়াতেই আমরা মিথ্যাশ্রয়ীদের তুলনায় দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আছি, আর পরলোকেও আমাদের পুরস্কার লাভের কোন সাম্ভাবনা নেই। এ কারণে মুহাম্মাদের (সা) এ শিক্ষা- মরণের পর আর একটি জগত হবে, সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মের ফল লাভ করবে-অত্যন্ত সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।”

 

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) এবং আমর ইবনুল আস (রা) একসাথে রাসূলুল্লাহর (সা)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) এর বাইয়াত গ্রহণের পর আমর ইবনুল আস রাসূলুল্লাহর (সা)-এর একটু নিকটে এসে আরজ করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! আমিও বাইয়াত গ্রহণ করবো। তবে আমার পূর্বের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিতে হবে। তিনি বললেন,

আমর, বাইয়াত কর। ইসলাম পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়, হিজরাতও পূর্বের সকল অপরাধ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আমি রাসূলুল্লাহর হাতে বাইয়াত করে ফিরে গেলাম। 

                  

ইসলাম গ্রহণের পরআমর ইবনুল আস (রা) মক্কায় ফিরে যান। কিছুদিন মক্কায় অবস্থানের পর আবার মদীনায় হিজরাত করেন। তিনি প্রত্যেক যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের পাশে ছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর যুগ যুগ ধরে লালিত কুসংস্কারের মূলোৎপাটনে আমর বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা) আরব উপদ্বীপের আশে-পাশের রাজা-বাদশাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন। ওমানের শাসক চিঠি পেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর রাসূল (সা) আমরকে ওমানের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। রাসূলুল্লাহর ওফাত পযর্ন্ত আমর ওমানেই অবস্থান করেন।

হযরত আবু বকরের (রা) খলিফা হওয়ার পর আরব উপদ্বীপে ভণ্ড নবী ও যাকাত অস্বীকারকারীদের ফিতনা ও বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে খলিফার নির্দেশে আমর ইবনুল আস (রা) ওমান থেকে বাহরাইনের পথে অগ্রসর হন। পরবর্তীতে খলীফা হযরত আবু বকর (রা) হিজরী ১৩ সনে সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী পাঠান। তিনি আমরকে লিখলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তোমাকে ওমানের ওয়ালী নিয়োগ করেছিলেন, তাই তোমাকে আমি দ্বিতীয়বার সেখানে পাঠিয়েছিলাম। এখন তোমার ওপর আমি এমন দায়িত্ব অপর্ণ করতে চাই যা তোমার চাই যা তোমার ইহ-পরকালের জন্য কল্যাণকর হবে। জবাবে আমর লিখলেন,

আমি তো আল্লাহর একটি তীর। আর আপনি একজন দক্ষ তীরন্দায। যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে এ তীর নিক্ষেপ করার অধিকার আপনার আছে। খলীফা তাঁকে ওমান থেকে সরিয়ে ফিলিস্তীন সেক্টারে নিয়োগ করেন।

 

খলিফা উমারের শাসনামলে আমর ইবনুল আস সিরিয়া বিজয় করে মিসরে অভিযান পরিচালনার জন্য খলিফার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। জাহিলী যুগে ব্যবসা উপলক্ষে আমর মিসরে আসা যাওয়া করতেন। এ কারণে মিসর সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ছিল। খলিফা প্রথমতঃ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করতে ইতস্ততঃ করলেও শেষ পর্যন্ত অনুমতি দান করেন। আমর তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মিসর রওয়ানা হলে খালীফা উমার তাঁকে সাহায্যের জন্য যুবাইর ইবনুল আওয়ামের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান।

দুই বছর মিসর অবরোধ করার পর খলিফা ওমর (রা) এর নির্দেশ অনুযায়ী আমর ইবনুল আস শত্রু বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইস্কান্দারিয়া মুসলিম বাহিনীর অধিকারে আসে। ইসকান্দারিয়া বিজয়ের পর তিনি বারকা, যুওয়াইলা, তারাবিলস, আল-মাগরিব, সাবরা প্রভৃতি অঞ্চল একের পর এক জয় করেন। তারাবিলস বিজয়ের পর তিনি দূত মারফত খলীফাকে সুসংবাদ পাঠান। তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল সেখান থেকে মাত্র নয় দিনের দূরত্বে। তিনি খলীফার নিকট এ সকল অঞ্চলে অভিযান পরিচালনায় অনুমতি চাইলেন। বিজিত অঞ্চলের শান্তি-শৃংখলার কথা চিন্তা করে খলীফা পশ্চিম আফ্রিকার অভিযান স্থগিত রাখার নির্দেশ দিলেন। আমর ইবনুল আসের আফ্রিকা অভিযান এখানেই থেমে গেল।

মিসর বিজয় শেষ হওয়ার পর খলীফা উমার (রা) তাঁকে মিসরের ওয়ালী নিয়োগ করেন। এর অল্প কিছু দিন পর হযরত উমার (রা) শহীদ হন। খলীফা উসমানও আমরকে তাঁর পূর্বে পদে বহাল রাখেন। এই সময় রোমান উস্কানীতে ইসকান্দারিয়াবাসীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আমর ইবনুল আস অত্যন্ত কঠোর হস্তে এ বিদ্রোহ দমন করেন এবং ভবিষ্যতে বিদ্রোহের আশংকায় ইসকান্দারিয়া শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীন ভেঙ্গে ফেলেন।

হিজরী ২৬ সনে হযরত উসমান (রা) তাঁকে মিসরের ওয়ালীর পদ থেকে অপসারণ করেন। তাঁর অপসারণের কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, মিসর অত্যন্ত উর্বর দেশ হওয়া সত্বেও আমরের সময়ে আশানুরূপ রাজস্ব আদায় হতো না। হযরত উমারের যুগ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ছিল। এ বিষয়ে খলীফা উমার (রা) তাঁকে একটি পত্রও লিখেছিলেন। হযরত উসমানের সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ছিল। হযরত উসমান (রা) এ ব্যাপারে তাঁকে একটি পত্র লিখেন আমর জবাব দেনঃ ‘গাভী এর থেকে বেশী দুধ দিতে সক্ষম নয়।’ এই জবাবের পর হযরত উসমান (রা) রাজস্বের দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে তা আবদুল্লাহ ইবনে সা’দের হাতে ন্যস্ত করেন। এই ঘটনার পর থেকে আমর ও আবদুল্লাহর মধ্যে মত বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং মিসরের শাসন ব্যবস্থা অনেকটা অচল হয়ে পড়ে।  হযরত উসমান (রা) আমরকে অপসারণ করে আবদুল্লাহকে মিসরের ওয়ালী নিয়োগ করেন। (তাবারী, ইবনুল আসীর) অন্য একটি বর্ণনা মতে ইসকান্দারিয়ার বিদ্রোহের পূর্বেই আমরকে অপসারণ করা হয়। বিদ্রোহ দেখা দিলে খলীফা উসমান তাঁকে বিদ্রোহ দমনে নিয়োগ করেন। বিদ্রোহ নির্মূলের পর খলীফা তাঁকে কেবল প্রতিরক্ষা বিষয়ক দায়িত্ব নিয়োগ করতে চান। তিনি খলীফার এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বলেন, “আমি শিং ধরবো, আর সে দুধ দুইবে” এমন হতে পারে না। তাবারী বলেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া খলীফা উসমান কাকেও অপসারণ করতেন না।

 

মিসরের ওয়ালীর পদ থেকে অপসারিত হয়ে মূলতঃ তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান এবং ফিলিস্তীনে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে মদীনায় আসা-যাওয়া করতেন। বিদ্রোহীদের দ্বারা খলীফা উসমান যখন অবরুদ্ধ হন, আমর ইবনুল আস তখন মদীনায়। তিনি যখন দেখলেন বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন এ কথা বলে মদীনা ত্যাগ করেন যে, উসমানের হত্যায় যার হাত থাকবে আল্লাহ তাকে অপমান করবেন এবং যে তাকে সাহায্য করতে পারবে না তার মদীনা ত্যাগ করা উচিত। তিনি মদীনা ছেড়ে সিরিয়া চলে গেলেন। তবে সব সময় লোক মারফত মদীনার খোঁজ-খবর রাখতেন। অতঃপর হযরত উসমানের শাহাদাত এবং উটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়; কিন্তু তিনি সিরিয়ার নির্জনবাস থেকে বের হলেন না। কোন কিছুতেই জড়িত হলেন না।

হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার মধ্যে বিরোধ শুরু হল। হযরত আলী হযরত মুয়াবিয়ার কাছে আনুগত্যের দাবী করলেন। মুয়াবিয়া আমর ইবনুল আসের সাথে পরামর্শ করলেন। বর্ণিত আছে, প্রথমত আমর মুয়াবিয়াকে বলেছিলেন, কোন অবস্থাতেই মুসলিম উম্মাহ আপনাকে আলীর পদমর্যাদা দেবে না। কিন্তু পরে দেখা গেল এই ঝগড়ায় আমর ইবনুল আস সম্পূর্ণভাবে মুয়াবিয়ার পক্ষ অবলম্বন করলেন। সিফফীনে উভয় পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তাতে আমর ছিলেন মুয়াবিয়ার (রা) বাহিনীর সিপাহসালার। আমরের পরামর্শেই এ যুদ্ধে আসন্ন পরাজয়ের মুহূর্তে বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে মুয়াবিয়া আলীর (রা) কাছে অপোষ-মিমাংসার প্রস্তাব দেন এবং আলীকে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণায় বাধ্য করেন। অতঃপর বিরোধ নিস্পত্তির লক্ষ্যে দু’সদস্য বিশিষ্ট যে সালিশী বোর্ড গঠন করা হয়, সে বোর্ডে আমর ইবনুল আস ছিলেন মুয়াবিয়ার মনোনিত, আর আবু মুসা আশয়ারী (রা) ছিলেন আলীর (রা) মনোনীত সদস্য।

আমর ও আবু মুসা আশয়ারী বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর দু’মাতুল জান্দালে উপস্থিত হলেন তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য। কিন্তু ঘোষণার মুহূর্তে আমর পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কূটনৈতিক প্যাঁচের মাধ্যমে মুয়াবিয়াকে খলীফা বলে ঘোষণা দান করেন এবং সাথে সাথে প্রতিপক্ষ আবু মুসার (রা) মুখ দিয়েও আলীকে (রা) বরখাস্তের কথাটি ঘোষণা করিয়ে নেন।

মুসলিম উম্মার অত্মঘাতী বিরোধ নিস্পত্তির যে সাম্ভাবনা সালিশী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে দেখা দিয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে তা হযরত আমরের কূটকৌশলের কারণে ব্যর্থ হয়। উভয় পক্ষে আবার বিরোধ ও যুদ্ধ শুরু হয়। আমর মিসর আক্রমণ করে হযরত আলী কর্তৃক নিযুক্ত মিসরের গর্ভণর মুহাম্মাদ বিন আবী বকরকে পরাজিত ও হত্যা করে মিসর দখল করেন।

অতঃপর চরমপন্থী খারেজী সম্প্রদায়ের কতিপয় লোক সিদ্ধান্ত নেয় যে, যেহেতু মুসলিম উম্মার বিভেদের কারণ প্রধানতঃ তিন ব্যক্তিঃ আলী, মুয়াবিয়া ও আমর। সুতরাং তাদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। ইবন মুলজিম, বারক বিন আবদিল্লাহ ও আমর ইবন বকর আত-তামীমীর ওপর এ কাজের দায়িত্ব অর্পিত হয়। সিদ্ধান্ত মুতাবিক নির্ধারিত দিন ও সময়ে তারা তিন জনের ওপর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালায়। হযরত আলী শহীদ হলেন, মুয়াবিয়া সামান্য আহত হয়ে বেঁচে গেলেন। আর আমর অসুস্থ থাকায় তাঁর পরিবর্তে খারেজা ইবন হুজাফা নামায পড়াতে বেরিয়েছিলেন, আততায়ী তাঁকেই আমর ইবনুল আস মনে করে আঘাত হানে এবং তাকে হত্যা করে। এভাবে আমারও বেঁচে গেলেন।

আমীর মুয়াবিয়া (রা) আমরকে মিসরের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন। মিসরের ওয়ালী থাকাকালে তাঁর ও আমীর মুয়াবিয়ার মধ্যে কিছুটা ভুল বুঝবুঝির সৃষ্টি হলেও তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং তিনি মিসরের ওয়ালীর পদে বহাল থাকেন। মিসরের ওয়ালী থাকাকালীন হিজরী ৪৩ মতান্তরে ৪৭ অথবা ৫১ সনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জীবনের আশা ছেড়ে দেন। জীবনের শেষ দিনগুলিতে তিনি অতীত ভুলের জন্য অনুশোচনায় ভীষণ দগ্ধিভূত হন।

আবদুর রহমান ইবন শাম্মাসা বলেন, তিনি আমর ইবনুল আসকে মৃত্যু শয্যায় দেখতে যান। আমর দেয়ালের দিকে মুখ করে কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ বললেন, আব্বা, কাঁদছেন কেন? রাসূলুল্লাহ (সা) কি আপনাকে অমুক অমুক বাশারাত বা সুসংবাদ দাননি? তিনি জবাব দিলেন, আমার সর্বোত্তম সম্পদ –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-এর শাহাদাত বা সাক্ষ্য। আমার জীবনের তিনটি পর্ব অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি পর্ব এমন গেছে যখন আমি ছিলাম কট্টর দুশমন। আমার চরম বাসনা ছিল, যে কোনভাবেই রাসূলুল্লাহকে (সা) হত্যা করা। তারপর আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু। রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাইয়াত করে ইসলাম কবুল করলাম। তখন আমার এমন অবস্থা যে, রাসূলুল্লাহর (সা) চেয়ে আর কোন ব্যক্তি আমার নিকট অধিকতর প্রিয় বা সম্মানী বলে মনে হয়নি। অতিরিক্ত সম্মান ও ভীতির কারণে তাঁর প্রতি আমি ভালো করে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। কেউ যদি এখন আমাকে তাঁর চাহারা মুবারক কেমন ছিল জিজ্ঞেস করে, আমি তাকে কোন কিছুই বলতে পারিনে। তখন যদি আমার মরণ হতো, জান্নাতের আশা ছিল। এরপর আমার জীবনের তৃতীয় পর্ব। এ সময় আমি নানা রকম কাজ করেছি। আমি জানিনে এখন আমার কি অবস্থা হবে। আমার মৃত্যু হলে বিলাপকারীরা যেন আমার জানাযার সাথে না যায়। দাফনের সময় ধীরে ধীরে মাটি চাপা দেবে। দাফনের পর একটি জন্তু জবেহ করে তার গোশত ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া যায়, এতটুকু সময় কবরের কাছে থাকবে। যাতে আমি তোমাদের উপস্থিতিতেই কবরের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারি এবং আল্লাহর দূতের প্রশ্নসমূহের জবাব ঠিক করে নিতে পারি। (মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)

তিনি তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে মৃত্যুর পর তাঁকে কিভাবে দাফন করতে হবে সে সম্পর্কে অসীয়াত করলেন। তারপর জিকরে মশগুল হলেন। বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ, তুমি নির্দেশ দিয়েছিলে, আমি তা অমান্য করেছি, তুমি নিষেধ করেছিলে, আমি নাফরমানী করেছি। আমি নির্দোষ নি যে, ওজর পেশ করবো, আমি শক্তিমানও নই যে, বিজয়ী হব।” তারপর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়তে পড়তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হিজরী ৪৩ সনের ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামাযের পর তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ জানাযার নামায পড়ান। মিসরের ‘মাকতাম’ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়। তাঁর নিজ হাতে তৈরী মিসরের প্রথম মসজিদ ‘জামে’ আমর ইবনুল আস’ –এর পাশে তাঁর কবরটি আজও চিহ্নিত রয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল নব্বই বছর।

ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আমর ইবনুল আসের জীবনের বেশী অংশ জিহাদের ময়দানেই কেটেছে। এ কারণে জ্ঞান অর্জন ও চর্চার সময় সুযোগ তিনি কমই পেয়েছেন। কুরআন তিলাওয়াতে তিনি বিশেষ পুলক ও স্বাদ অনুভব করতেন। অত্যন্ত সুন্দর করে তিলাওয়াত করতেন। জীবনটি জিহাদের ময়দানে কাটলেও যতটুকু সময় পেয়েছেন রাসূলুল্লাহর (সা) সুহবত থেকে ইলম ও আমলের উন্নতি সাধন করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ৩৯টি হাদীস বা বাণী তিনি বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে ৩টি মুত্তাফাক আলাইহি অথাৎ বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। ৩টি এককভাবে মুসলিম বর্ণনা করেছেন। বহু সাহাবী ও তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হযরত আমর ইবনুল আস জিহাদের ব্যস্ততা সত্বেও শিক্ষাদান ও ওয়াজ-নসীহতের দায়িত্বও পালন করতেন। ‘জাতুস সালাসিল’ যুদ্ধে বিজয়ের পর সেখানে অবস্থান করে নও-মুসলিমদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের পর দুনিয়ার প্রতি কিছু মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেলে তিনি বক্তৃতা-ভাষণে রাসূলুল্লাহর আদর্শ অনুসরণের প্রতি মানুষকে আহবান জানাতেন।

তিনি সাহিত্য রসিকও ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক। অল্পকথায় অধিক ভাব প্রকাশ, সুন্দর উপমা প্রয়োগ এবং বাক্য ও ভাবের অলঙ্করণ তাঁর সাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে তাঁর সাহিত্যের বহু নমুনা সংরক্ষিত হয়েছে। বিশেষতঃ ‘আমুর রামাদাহ’ অর্থাৎ যে বছর আরবে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, সে বছর খলীফা উমার মদীনা থেকে মিসরে অবস্থানরত আমরকে খাদ্যশস্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন এবং সে চিঠির জবাবে আমর যে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন তা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। তাছাড়া তাঁর বক্তৃতা-ভাষণ, পত্রাবলী ও বিভিন্ন ধরনের লেখায় সাহিত্যে প্রতিভার প্রকাশ ঘটেছে।

হযরত আমর ইবনুল আসের সমগ্র জীবন আলোচনা করলে দেখা যায় তিনি তাঁর জীবনে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্ব অতিক্রম করেছেন। সবগুলি পর্বে তিনি সমানভাবে সফলকাম হতে পারেননি। বিশেষতঃ সাহাবী জীবনের শেষ পর্বের কিছু ঘটনার যৌক্তিক আপাতঃ দৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামী উম্মাহ ইমামরা জীবনের শেষ পর্বের এসব ভূমিকাকে তাঁর ইজতিহাদী ভুল বলে সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। তবে জীবনের এ পর্বের কতিপয় বিতর্কিত ঘটনা ছাড়া অন্য সকল সাহাবীদের মত তাঁর সামগ্রিক জীবনকে রাসূলুল্লাহর (সা) সুহবত বা সাহর্য ফুলের মত শুভ্র ও সুন্দর করে তুলেছিল। জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের কতিপয় ব্যক্তির অন্যতম।

 

 

 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম ব্যক্তিত্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


(জন্মঃ ৮১০-মৃত্যুঃ ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ), আরব রীতি অনুযায়ী বংশধারাসহ পুরো...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-22 11:55:49

ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই ভারতের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। বা...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-04-08 09:16:03

ইবনে রুশদ ছিলেন আধুনিক সার্জারির জনক। সেই সাথে ছিলেন একজন বড় মাপের আধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-12-01 00:44:18

সাহাবী  হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলতেন- আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং নাম...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2020-02-06 18:38:47

ভাবুন তো... আপনার খুব কাছের কোনো বন্ধু আপনার বাসার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গে...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2019-02-15 23:46:59

সংখ্যার জগতে ‘শূণ্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গণিতের প্রাথমিক ১-৯ সংখ্...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-13 13:42:39

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2017-10-28 14:09:44

অনেকদিন আগে, দামিশকের একজন পিতা তার পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতে বের হয়েছিল...

মুসলিম ব্যক্তিত্ব | 2018-02-01 20:15:53