ম্যালকম এক্স এর যুগান্তকারী হজের অভিজ্ঞতা


শেখ আহমদ কুট্টি; ভাবানুবাদঃ হুমায়রা হুসাইন
Published: 2022-06-28 21:10:33 BdST | Updated: 2024-05-03 19:12:12 BdST

 

ম্যালকম এক্স ১৯৬৪ সালে হজে গিয়েছিলেন। যদিও তিনি বর্ণবাদ ও কালো জাতীয়তাবাদে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু হজ্ব থেকে আমেরিকায় ফিরে আসেন একজন পরিবর্তিত মানুষ হয়ে। হজ্বের আগে, তিনি মানবতাকে কালো এবং সাদাতে বিভক্ত করায় বিশ্বাসী একজন ছিলেন কিন্তু তার হজের অভিজ্ঞতা তাঁর এই বিশ্বাসটিকে পরিবর্তন করে দেয়। হজ্ব ম্যালকম এক্সকে এমনভাবে রূপান্তরিত করে দেয় - যেন তিনি পুনর্জন্ম পেয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি শুধু মানবজাতির সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না; কিন্তু তিনি হজ্ব থেকে যে আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন তার জন্য কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।


প্রশ্ন হল: এটা কিভাবে ঘটল?
প্রথমত, ম্যালকম এক্স হজ্ব টি পালন করেছিলেন আন্তরিকতা সহকারে এবং সত্যিকার অর্থে ের থেক শিক্ষা গ্রহনের নিয়তে। তিনি নিজেকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন:
“আমার কথাগুলো হতবাক করার মতো হলেও সত্য। এই যাত্রায়, আমি যা দেখেছি, এবং অভিজ্ঞতা করেছি, তা আমাকে আমার পূর্বে ধারণকৃত অনেক চিন্তা-চেতনাকে পুনর্বিন্যাস করতে এবং আমার আগের কিছু সিদ্ধান্তকে সরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।"
এবং তার জীবন-পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
“আমি কখনই এমন আন্তরিক আতিথেয়তা এবং সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের অপ্রতিরোধ্য চেতনার প্রত্যক্ষ করিনি যা এখানে এই প্রাচীন পবিত্র ভূমিতে আমি পেয়েছি। যেই শিক্ষা ইব্রাহিম (আ ), মুহাম্মদ (সা ) এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া এবং যেখানে নেই কোন উচুনীচু বা বর্ণবাদ। সেখানে সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। তারা নীল চোখের স্বর্ণকেশী থেকে কালো চামড়ার আফ্রিকান সব রঙের ছিল। আমরা সবাই একই আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলাম এটি ছিল আমার দেখা একতা, ভ্রাতৃত্বের চেতনার এক অভূতপূর্ব নিদর্শন যা আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস – “যে সাদা এবং শ্বেতাঙ্গরা কখনোই একসাথে থাকতে পারে না।"- এটাকে ভিত্তিহীন প্রমান করে দেয়।
তিনি আরো বলেন “আমেরিকাকে ইসলামকে বুঝতে হবে, কারণ এটিই একটি ধর্ম যা তার সমাজ থেকে উঁচুনিচু বিভেদ ও বর্ণ গোত্র প্রথা ইত্যাদি মুছে ফেলে। মুসলিম বিশ্বে আমার ভ্রমণের সময়, আমি এমন লোকদের সাথে দেখা করেছি যারা তথাকথিত বর্ণবাদ বিবেচনায় “সাদা”, কিন্তু তাদের সহচার্য থেকে আমি তাদের যে অমায়িক ব্যবহার, দ্বীন, বিনয় , মনের নিরংকুশতা দেখেছি তাতে এই সামান্য “সাদা” বা গায়র রঙের কোন্রূপ প্রভাব ছিলনা। ছিল ভ্রাতৃত্ব। ম্যালকম-এক্স এটি দ্বীনের সৌন্দর্য টিকে অর্জন ও ধারন করতে সক্ষম হয়েছিল কারণ তিনি তার পূর্বের সকল বিশ্বাসকে পরিবর্তন করতে এবং সত্যকে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। হজ্ব তাকে প্রাণবন্তভাবে শিখিয়েছিল এক স্রষ্টার অধীন থাকা ও তাঁর প্রদত্ত শান্তির বার্তা, এবং বিশ্বব্যাপী ভ্রাতৃত্ব কায়েমের গুরুত্ব। এই শিক্ষা প্রভুর সাথে তার সংযোগকে আরও গভীর করেছিল; আস্থা ও ত্যাগের সত্যিকারের চেতনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল; এবং সর্বোপরি, তিনি ইসলাম (আত্মসমর্পণ) এবং ইমান (ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস) এর গভীর অর্থ অনুভব করেছিলেন। কি কি শিক্ষা আমরা পেতে পারি হজ্ব থেকে
১. সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক গভীর করে
হজ্ব -আমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং প্রভু আল্লাহর সাথে আমাদের সংযোগ সম্পর্কে গভীর করে। রাসুল (সা ) আমাদের শিখিয়েছেন যে হজ্জের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত ইবাদত আল্লাহর স্মরণে এবং এর মাধ্যমে আমাদের আল্লাহর সাথে সম্পর্ক আরো গভীর হয়। তাই, যখন আমরা আল্লাহর প্রিয় নবীর দৃষ্টান্ত তাঁর প্রতিদিনের দোয়া ও যিকিরের অনুশীলনে অনুকরণ করি তখন তাঁর চর্চা টা এমন হতে হবে যাতে প্রতিনিয়ত অভ্যাসের মতো আমরা রবের স্মরনে এই জিকির ও দুয়াগুলো পড়তে থাকতে পারি।
২. হজ্ব মৃত্যু সম্পর্কে স্মরন করিয়ে দেয়
তীর্থযাত্রীদের তাদের শেষ যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয় যখন তারা ইহরামের পোশাক পরে - অনেকটা কাফনের মতোই যে আমরা মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়ার সময়ে প্রিয়ে থাকি। নিজেদের রুহ কে রবের স্মরনে ব্যস্ত রাখা ও আল্লহর সন্তোষ লাভের জন্য জন্য যিকর এবং মৃত্যুর স্মরণের চেয়ে ভাল উপায় আর নেই।
৩। হজ্ব থেকে আমরা ভ্রাতৃত্ব শিখি
যেটা চর্চা উত্তম উপায় হলো মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করা। আমরা যখন মসজিদে আসি, তখন বিশ্বাস ও মানবতার সাথে সকলকে ভাই হিসাবে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছুক হতে হবে। নবীজি বললেন
“আল্লাহর কসম, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান না আনবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা না হওয়া পর্যন্ত তোমরা ঈমান আনবে না। আমি কি আপনাকে এমন কিছু করার জন্য নির্দেশনা দিতে পারি যাতে আপনাদের পারস্পারিক মহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব বাড়বে ও অটুট থাকবে? ? নিজেদের মধ্যে সালাম (সালাম) ছড়িয়ে দিন।" (মুসলিম)।
তাই মসজিদে কারও সাথে দেখা হলে সর্বপ্রথম সালাম বিনিময় এর মাধ্যমে এই ভালবাসার চেতনা ভাগ করুন।
৪। জামায়াতে নামায আদায় করার অভ্যাস গড়ে তোলা
জামাতে নামাযের ওপর একটি উদ্দেশ্য হজ্বের মতোই, নির্বিশেষে সকল আকার ও বর্ণের বিশ্বাসীদের সাথে ভাইয়ের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। তাই সালাহর ক্ষেত্রে সচেতন ও পরিশ্রমী হওয়া আমাদের সবার জন্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
৫। কোরান বুঝে পড়া ও তা আমল করা
যেহেতু কোরান হল সম্পূর্ণ জীবনবিধান , দিকনির্দেশনা ও সকল জ্ঞান এর উৎস , তাই আমাদের প্রতিদিন কুরআন পাঠ করা উচিৎ। কোরান বুঝে পড়া ও তা আমল করার জন্য পড়ার পর তার গ্রহনযোগ্যতা ও মেনে নেয়ার জন্য একদম সহজ ও মানসিক উদারতা থাকা আবশ্যক। উন্মুক্ত মনে কুরআন থেকে নির্যাস নিয়ে বাস্তব জীবনে তাঁর প্রতিফলন ঘটানোর এই লক্ষ্য অর্জনে কুরআন নিয়মিত চর্চার কোন বিকল্প নেই ।
৬। শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করার শিক্ষা
হজ্ব আমাদের সার্বজনীন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং সকলের সাথে শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করার জন্যপ্রশিক্ষণ দেয়। তাই অন্য মতাদর্শীদের সাথে জীবনযাপনের শিক্ষা , বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি এবং উদারতার চর্চা করা উচিত। সামাজিক কাজ যেমন মসজিদ, স্কুল, অফিস, হাসপাতাল ইত্যাদির মাধ্যমে এটি চর্চার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
৭। নফস কে সংযত রাখা
যেহেতু পৃথিবী প্রলোভনে পূর্ণ, হজ্ব এই প্রলোভন থেকে আমাদের নফস কে সংযত রাখতে সাহায্য করে।আমাদের শয়তানের ফাঁদ ও প্রলোভন সম্পর্কে সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; যিকিরে স্থিরতা, মৃত্যুর চিন্তা এবং রবের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার শিক্ষা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে সাহায্য করে। ইমাম শাফিঈ বলেন, "আপনি যদি নিজেকে ভাল কাজের সাথে ব্যস্ত না করেন তবে আপনার দৈহিক আত্মা আপনাকে পাপের (অর্থাৎ শয়তানের কাজ) দ্বারা আবদ্ধ রাখবে।"


৮. তওবা ও ইস্তিগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া)
একজন ঋষি বললেন,"কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তি তারাই যাদের খাতা ইস্তিগফারে ভরে যাবে।"“আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর কাছে শেষ আশ্রয় খুঁজে নিতে আহ্বান করেন তবা করার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে। ইস্তিগফারের মাধ্যমে আমরা নিজেদের ব্যর্থতা, কুপ্রবৃত্তি ও পাপ থেকে আল্লাহর দিকে পলায়ন করি। পরিশেষে আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের সমস্ত বড় এবং ছোট, গোপন এবং প্রকাশ্য, জানা অজানা পাপের ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করবো - আমীন।

উৎস

 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিবিধ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


মক্কার পবিত্র কাবার ঘরের সংলগ্ন উত্তরের কিছু অংশ অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্ত...

বিবিধ | 2018-08-14 23:29:33

আমরা কোনো কঠিন মূহুর্ত বা বিপদের সম্মুখীন হলে খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ি। আল...

বিবিধ | 2021-06-24 04:03:23

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, উভয় ধর্মেই পৃথিবীর সমাপ্তির পর্বের মিথ্যা খোদা দা...

বিবিধ | 2021-09-05 19:36:28

গত ১৪ই জুন ক্রীড়াজগতের অন্যতম বৃহত্তম আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের আনুষ্ঠানিক...

বিবিধ | 2018-06-22 22:32:19

রাত ১২টা বা ১টা পর্যন্ত জেগে থাকাটা ছিল আমার অন্যতম একটি বদভ্যাস। ছোট...

বিবিধ | 2018-03-26 09:49:08

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, উভয় ধর্মেই পৃথিবীর সমাপ্তির পর্বের মিথ্যা খোদা দা...

বিবিধ | 2019-02-17 23:09:17

ইবনে খালদুন আসাবিয়াতত্ত্ব বা গোষ্ঠী সংহতির উপর রাষ্ট্র দর্শনের ভিত্তিক...

বিবিধ | 2019-03-29 23:50:18

১. ধৈর্যশীল যিনি সব পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণে সক্ষম, কখনোই চিৎকার চেঁচাম...

বিবিধ | 2021-09-04 20:19:56